 |
নাহিদ হাসান |
১.
জন্ম থেকেই বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের ভূত দেখে আসছে। কিন্তু দেখতে দেখতে সেই ভূত বাস্তব হয়ে ঘাড়ে চেপে বসেছে কিনা, এই তর্ক টেবিল থেকে রাস্তা পর্যন্ত। নাকি ভ্রুণ থেকে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নিয়ে অধির আগ্রহে কাতরাচ্ছিল, যাকে কেউ কেউ বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের হেঁটে হেঁটে ভারত যাত্রার মধ্যেই তা রয়ে গিয়েছিল? নইলে জন্মেই কিভাবে রক্ত স্নাত এত বড় জনগোষ্টীকে স্রেফ পাশ কাটিয়ে একব্যক্তিকেন্দ্রীক সংবিধান প্রনয়ণকরা সম্ভব হলো? গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এত আত্মদানের পরও জন্ম থেকেই বাংলাদেশে রাজতন্ত্র কায়েম হয়ে আছে। পরাধীন সমাজ ও সংস্কৃতিতে বাক্যবাগীশ ও ক্যারিশম্যাটিক নেতা তৈরি হবে, এটা স্বাভাবিক। ইওরোপে যা অস্বাভাবিক, আমাদের এখানে যেন তা স্বাভাবিক! রুশ তাত্ত্বিক লিঁও ট্রটস্কি বলেছেন, যে মুহূর্তে বুর্জোয়া একনায়কতন্ত্র তার সংসদীয় কাঠামো ও 'স্বাভাবিক' পুলিশও মিলিটারী পরিকাঠামোর মাধ্যমে সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, সেই মুহূর্তটাই ফ্যাসিবাদী মুহূর্ত।
আর বাংলাদেশ তো এখনও বুর্জোয়া গণতন্ত্রের স্তরেই পৌঁছে নাই। তবে এটাও ঠিক, বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব এখানে না সংগঠিত হলেও, কৃষিসহ সর্বত্র ধনতন্ত্রের বিকাশমান পরিস্থিতি থাকায় বুর্জোয়া সংস্কৃতির উপাদানগুলোরও বিকাশ ঘটেছে। ফলে উন্মত্ত পেটি বুর্জোয়া জনতা, শ্রেণীচ্যূত গোষ্ঠীগুলো ও জাতি-ধর্মগর্বী ছাত্র সমাজেরও জন্ম ঘটেছে, যারা ফ্যাসিবাদের অন্যতম হাতিয়ার। এদেরকে দিয়েই সার্বভৌম ক্ষমতার সমস্ত প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক ও মতাদর্শীক প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনী, বিচার ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, প্রেস, ট্রেড ইউনিয়ন ও সমবায় সমিতিসহ সমস্ত ক্ষমতা করায়ত্ত করে নেয়। তাই আমরা ইতালি-জার্মানির ফ্যাসিস্ট প্রবণতাও দেখব, আবার লাতিন আমেরিকার হত্যা-গুম-অপহরণের সংস্কৃতিও দেখব। আবার আমরা দেখব, পরাধীন আমলে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ও জনগণ যে পরিমাণ বাক স্বাধীনতা ভোগ করতেন, স্বাধীন দেশে তাও কেড়ে নেয়া হয়েছে। আমার শিল্প-সাহিত্য ও রাজনীতির দিকে তাকালেই আমরা তুলনাটা টের পাবো।
ইতালির ফ্যাসিস্ট দলের নেতা মুসোলিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা যে তিনটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে নিজে তালুবন্দী করে, সেগুলো হচ্ছে: ১. রাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণের অধীনে শ্রমিকদের সঙ্গে পুঁজিপতিদের সহযোগ স্থাপন ও বাধ্যতামূলক আপোসের বন্দোবস্ত করা। ২. রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রস্থ করা। এবং ৩. প্রেসের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন করে সংকুচিত করা।
আগে আমরা মে দিবসে স্লোগান শুনতাম, দুনিয়ার মজুর এক হও! এখন শুনি, শ্রমিক-মালিক ভাই ভাই। সংবিধান পড়লেই বুঝি, ৭২ সাল থেকে সকল ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। অর্থাৎ মুসোলিনির ১ থেকে ৩ নম্বর শর্ত ৭২ সাল থেকেই বহাল। সেজন্য ৭২ সাল থেকেই ফ্যাসিবাদ শব্দটি রাজনৈতিক এলাকায় চালু আছে।
মুসোলিনির আমলে ইতালি ঘুরে বেড়িয়েছেন জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সন্তান সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি সেখানে অর্ধাহারে-অনাহারে লোকজনকে যক্ষায় মরতে দেখেছেন। দেখেছেন, পথে পথে অসংখ্য ভিক্ষুক। অথচ ফ্যাসিস্ট নেতারা প্রায়ই বলতেন, ইতালিতে ভিক্ষুক নেই। গ্রামে-গঞ্জে জনগণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কোন চিহ্ন না দেখতে পেলেও মুসোলিনিকে প্রায়ই বলতে শুনেছেন, 'যখন পৃথিবীর অন্য সমস্ত দেশে ক্রাইসিসের ফলে জনসাধারণের অবস্থা শোচনীয় থেকে শোচনীয়তর হয়ে উঠেছে, একমাত্র ফ্যাসিস্ট ইতালিতেই জনসাধারণের অবস্থার উন্নতি ঘটেছে।' -যেমনটি আমরা বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হতে দেখি সাগরে সাগরে কাজের সন্ধানে বাংলাদেশিদের মরতে দেখেও।
২.
ইতালি প্রথম মহাযুদ্ধের অস্ট্রিয়ার অন্তর্গত দক্ষিণ তিরোল দখল করে নেয়। সেই দক্ষিণ তিরোলের জার্মাণ অধিবাসীদের ইতালিয়ান করে তোলার জন্য মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকার ১৯২৩ সালের জুন মাসে একটি প্রোগ্রাম ঘোষণা করে: দক্ষিণ তিরোলে রাষ্ট্রের সমস্ত অফিসে কেবল ইতালীয় ভাষা ব্যবহার, সেখানকার জার্মাণ কর্মচারিদের ইতালির অন্য প্রদেশে বদলি, শহর ও রাস্তাগুলির পুরাতন জার্মাণ নাম বদলে ইতালীয় নাম রাখা, পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি, ইতালীয়দের দক্ষিণ তিরোলে পাঠিয়ে সেখানকার জমি দখল করে বসবাসের বন্দোবস্ত করা, ইতালীয় ভাষাকে চালু করা, বিচারালয়ে ইতালীয় কাজকর্ম ও বহুসংখ্যক ইতালীয় সৈন্য মজুদ রাখা।-এই সমস্ত কাজ আমাদের শাসকশ্রেণীও পার্বত্য এলাকায় করেছে এবং আমাদের কাছ থেকে তার সম্মতিও আদায় করেছে।
সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৪ সালে তাঁর 'ফ্যাসিবাদ' বইএ শিল্পী-সাহিত্যিকরা কীভাবে মুসোলিনিকে সমর্থন যুগিয়েছেন, তা আমরা বুঝব ফিউচারিস্টদের সঙ্গে ফ্যাসিজমের সম্পর্ক কী, এটা ফিউচারিস্টদের নেতা মারিনেত্তি লেখককে কী বলেছেন তা থেকেই। মারিনেত্তি তাঁকে বলেছেন, "ফ্যাসিজম ফিউচারিজম ও মহাযুদ্ধে ইতালির যোগদানের ফলস্বরূপ। ফ্যাসিজম ফিউচারিজম দ্বারা নিজেকে পুষ্ট করেছে। ফ্যাসিজমের মধ্যে সেই জাতীয়তার গর্ব, ঘোরতর যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ও স্বদেশপ্রেম আছে ও সর্বদা থাকবে, সেগুলির সম্পর্কে আমরা ফিউচারিস্টরাই ইতালির জনসাধারণকে সর্বপ্রথম সচেতন করে তুলি।"
বলা ভাল, ১৯২২ সালে মুসোলিনির সরকার গঠনের সাথে সাথে এই কবি-সাহিত্যিক-সম্পাদকরা ফ্যাসিস্ট মূর্তিতে দেখা দেয়। তারা প্রচার করত, ইতালির ভবিষ্যৎ হচ্ছে ন্যাশনালিজম ও ধর্মের বিস্তারের দ্বারা আধ্যাত্মিক জীবনের আদর্শ প্রচার করা।-আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মদীনা সনদ কি একসাথে চলছে না?
৩.
বিপুল সংখ্যক মানুষের যুক্তিবোধকে অসার করে দেওয়াটা ফ্যাসিস্ট প্রচারের লক্ষ্য। নেতাকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন করতে পারার মধ্যে ফ্যাসিবাদের প্রচার নির্ভরশীল। নেতা আর সাধারণের মত না, এটা প্রমাণ করতেই হবে। মুসোলিনি দুচে আর হিটলার ফুয়েরার। রাষ্ট্রনেতাকে শুধু তার নামে ডাকা যাবে না। নেতাকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মিথ্যা তৈরি করা হয়। ঠাণ্ডা মাথায় নেতার ভাবমূর্তি তৈরি করা হয়। গোটা ইতালি জুড়ে একটা স্লোগান তোলা হয়, মুসোলিনি সব সময় সঠিক। ইতালি জুড়ে মুসোলিনির ছবি, তার নিচে স্লোগান: বিশ্বাস কর, মেনে চলো, লড়াই কর। তার তিন ধরনের ভাবমূর্তি তৈরি করা হয়: ১. তিনি নবজাগরণের প্রতিনিধি, ২. অনন্য সাংগঠনিক প্রতিভা ও ৩. সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি। কবি এজরা পাউণ্ড এবং স্বল্প সময়ের জন্য রবীন্দ্রনাথও মুসোলিনির গুণমুগ্ধ ছিলেন। পুরো ইতালির ইতিহাসবিদ ও কয়েকশ জীবনীকার এটা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন যে, জন্ম থেকেই তিনি কত বড় প্রতিভাবান ছিলেন! ক্রমাগত মিথ্যা প্রচারে মুসোলিনি নিজেই মিথ্যাকে বিশ্বাস করতে ও পরম ভাবতে শুরু করেছিলেন।-আশা করি আমরা আমাদের ইতিহাসের সাথে মিল পেয়ে যাচ্ছি।
৪.
ইতালি আর জার্মানি ছিল সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র, আর বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদের শিকার। কিন্তু শাসকশ্রেণীর আচরণের মধ্যে সাদৃশ্য। এগুলো ফ্যাসিবাদের উপরি দিক। মর্মবস্তুতে ফ্যাসিবাদ বুঝতে হয় উৎপাদন-সম্পর্কে, ব্যাংক ও শিল্প পুঁজির দ্বন্দ্বের মধ্যে। বাংলাদেশ সে জায়গায় যায়নি, কিন্তু ভারত সেই যাত্রায় উপস্থিত। ৪০ লক্ষ বাঙালি আর মাও বাদের ভূত দেখার রাজনৈতিক প্রবণতার মধ্যদিয়ে ফ্যাসিবাদের ভূত বাস্তব হয়ে ওঠে, তা উপরে বললাম। বাংলাদেশ ভারত নামের ফ্যাসিবাদী দেশের ক্রীড়া ক্ষেত্র হিসেবে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা হাজির করছে নিজ রাষ্ট্রের ভূত-ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়েই। ইতালি-জার্মানিতে ফ্যাসিস্টদের উত্থান ঘটেছিল বলশেভিক বিপ্লবকে মোকাবিলার জন্য, বাংলাদেশেও ফ্যাসিবাদী রাজনীতি চালু হয়েছে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে ঠেকাতেই। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে পপুলার ফ্রন্ট ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করেছে ইওরোপে, আমরা প্রবণতাকে ঠেকাব কী করে? স্বাধীন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণের লড়াই ছাড়া এই ফ্যাসিবাদের ভূত ঠেকানোর ওঝা নেই।
লেখকঃ সভাপতি, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।
nahidknowledge@gmail.com