This is default featured slide 1 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.This theme is Bloggerized by Lasantha Bandara - Premiumbloggertemplates.com.

This is default featured slide 2 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.This theme is Bloggerized by Lasantha Bandara - Premiumbloggertemplates.com.

This is default featured slide 3 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.This theme is Bloggerized by Lasantha Bandara - Premiumbloggertemplates.com.

This is default featured slide 4 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.This theme is Bloggerized by Lasantha Bandara - Premiumbloggertemplates.com.

This is default featured slide 5 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.This theme is Bloggerized by Lasantha Bandara - Premiumbloggertemplates.com.

Showing posts with label বিজ্ঞান. Show all posts
Showing posts with label বিজ্ঞান. Show all posts

বিবর্তনবাদ কি বৈজ্ঞানিক সত্য ?

মানুষের উৎপত্তি কিভাবে এ নিয়ে দীর্ঘদিন বিজ্ঞান, দর্শণ ও ধর্মের মাঝে বির্তক চলছে। মানুষের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে নতুনকে জানতে চায়। আর সে জন্যই সে রাজত্ব করছে দূর মহাকাশে, সাগর তলে এবং মর্ত্যরে এ পৃথিবীতে। পৃথিবীর প্রধান চারটি ধর্মই বলছে মানুষের উৎপত্তি এক জোড়া নর-নারী থেকে।




কিন্তু বিজ্ঞানের মূল কথাই হল প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর যথার্থ কারণ অনুসন্ধান ও তার পর্যবেক্ষণ। তাই আজকের এ বিশাল মানবজাতি কিভাবে আসল, প্রাণের উৎপত্তি কিভাবে এ প্রশ্নের উত্তর প্রাপ্তি বিজ্ঞানের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।

বর্তমান সময়ে একটি  ‘ Theory’  বা তত্ত্ব সবার মাঝেই প্রচলিত। আমাদের অধিকাংশ মানুষের এ তত্ত্বটি নিয়ে একটি ভুল ধারনা রয়েছে। সেটি হল ডারউইনের বিবর্তবাদ ( Evolution),  এ তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষের উৎপত্তি বানর থেকে। আর সবাই ভাবতে থাকে বিজ্ঞান ও ধর্ম সাংঘর্ষিক। আমাদের মাঝে সে ভুল ধারণাটি সেটি হল আমরা ভাবি বিবর্তনবাদ বৈজ্ঞানিক সত্য বা, এর পিছনে অনেক শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে। আসলে বিবর্তনবাদ হল Theory  বা, তত্ত্ব, কোন Fact,  বা, বৈজ্ঞানিক সত্য না। অর্থাৎ, এটি এখনও অপ্রমানিত। তাহলে যে, প্রশ্নটি সবার মনে জাগে যেটি হল এ অপ্রমানিত তত্ত্বটি এত ব্যাপকভাবে কেন প্রচারিত হল? এর উত্তরটি আসলে পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায়। গ্যালিলিও যখন বাইবেলের বিপক্ষে কথা বললেন তখণ তাঁকে হত্যা করা হল। আর এটি তখণকার সময়ে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের মনে দাগ কেটেছিল। সে সময় থেকে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের বিরোধ শুরু হল। যখন বিবর্তনবাদ প্রকাশিত হল তখণ অধিকাংশ বিজ্ঞানীরা এটি সমর্থন করেছিল কারণ এটি ধর্মের বিরুদ্ধে যায়। আজও শুধু ধর্মের বিরুদ্ধে যায় বলেই এটি এত ব্যাপকভাবে প্রচলিত।

বিবর্তনবাদ কী? এর আরেকটি নাম হল প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদ  Tneory of natural Selection) এর মূল কথাটা এমন, ‘‘ প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সরল কোষ ধীরে ধীরে জটিল হয়ে এবং সরল জীব টিকে থাকার জন্য প্রাকৃতিক নিয়মেই পরিবর্তিত হয়ে জটিল অবস্থার রূপ নেয়।’’

সংক্ষেপে বলতে গেলে, ”Survival of the fittest”  পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়িয়ে নেওয়ার জন্য জীব সরল থেকে জটিল হয়। ডারউইন এ তত্ত্বটি দেন ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বিখ্যাত গবেষনাপুস্তক ”Origin of species by means of natural selection”.  এ তত্ত্বটি তিনি দেন গেলাপেগোস দ্বীপে চার বছর গবেষনার পর। তিনি খাবার গ্রহণের উপর পাখিদের ঠোঁটের আকৃতির পরিবর্তন লক্ষ্য করে এই তত্ত্বটি দেন। বর্তমান সময়ে বিজ্ঞান এতটাই অগ্রসর যা তখনকার সময়ে ছিল না। তাই জেনেটিকস্ মাইক্রোবায়োলজি, এমব্রায়োলজি এ শাখাগুলো বিকাশের সাথে সাথে নতুন নতুন তথ্য উম্মেচিত হয় এবং বিবর্তনবাদ একটি পঙ্গু তত্ত্বের রূপ নেয়। এখানে কতগুলো যুক্তি দেওয়া হল যা বিবর্তনবাদকে একটি ভিত্তিহীন তত্ত্বে রূপান্তরিত করে।

 

যুক্তি নং ১ : স্লাইডেন এবং সোয়ান যারা কোষ তত্ত্বের প্রবর্তক তাঁরা বলেছেন ”Every cell comes from a pre-existing   cell”  প্রত্যেকটি কোষ শূন্য থেকে আসে না। তার অবশ্যই একটি মাতৃকোষ থাকে। ভারউইনের বিবর্তবাদ এটির ব্যাখ্যা দিতে পারে না যা কিভাবে জীবনের উৎপত্তি হল। আর সে জন্য বিবর্তনবাদ একটি ভ্রান্ত তত্ত্বে পরিণত হয়েছে।

যুক্তি নং ২ : DNA  হচ্ছে জীবনের রাসায়কি ভিত্তি। এ DNA  এর উপাদান ৫টি কার্বন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও ফসফরাস। DNA  গুলো অ্যামিনো এসিড তৈরী করে আর এই অ্যামিনো এসিডগুলো প্রোটিন তৈরী করে। আজকের বিজ্ঞান আমাদের বলে একটি DNA অনু যদি হঠাৎ করে তৈরী হত ( বিবর্তনবাদ অনুযায়ী) তবে এর সম্ভাবনা 1/10-268  যা শূন্যের কাছাকাছি। এমনকি বিশ্ব জগতের সব অনুপরমানু একত্রিত করেও একটি DNA  তৈরী করা সম্ভব না। বর্তমান এত উচ্চমানের গবেষনাগারেও বিজ্ঞানীরা শূন্য থেকে কোষ তৈরী করতে সক্ষম না।

যুক্তি নং ৩ : Thermodynamics এর 2nd Law  অনুযায়ী, প্রত্যেকটি সিস্টেম সুশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বিশৃঙ্কল অবস্থার দিকে যায় যদি বাহিরের কোন শক্তি এটিকে নিয়ন্ত্রন না করে। ডারউইনের বিবর্তবাদ অনুযায়ী প্রাকৃতিক নিয়মেই সুশৃঙ্খল ভাবে সরল জীবগুলো জটিল অবস্থার রূপ নেয়। Thermodynamics এর সূত্রানুযায়ী, স্রষ্টার সুশৃঙ্খল পরিকল্পনা ছাড়া প্রাকৃতিক নিয়মে  কখনোই সরল জীবগুলো জটিল অবস্থা লাভ করতে পারে না। তাই Tneromodynamics যা প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্য তা বিবর্তনবাদকে অস্বীকার করে।

যুক্তি নং ৪: পৃথিবীর এ বিচিত্র প্রাণীর সমারোহ দেখে আমরা কখনোই ভাবতে পারি না মানুষের উৎপত্তি বানর থেকে। কেননা প্রত্যেকটি প্রাণীর ক্রোমোসোম সংখ্যা নির্দিষ্ট। এর কম বা, বেশি হলে প্রাণীটি তার অস্তিত্ব হারায়। বানরের ক্রোমোসোম থেকে মানুষে উৎপত্তি হওয়াটা বিজ্ঞানের কাছে হাস্যকর।

যুক্তি নং ৫: Muation  বিবর্তনবাদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বিবর্তনবাদ অনুযায়ী সরীসৃপ হতে বিবর্তিত হলে এসেছে পক্ষীকূল। আজকের বিজ্ঞান প্রমাণ কর যে, Muation  অর্থাৎ জীনের পরিবর্তনের মাধ্যমে কোনো জীবের বৈশিষ্ঠ্যের পরিবর্তন করা যায় কিন্তু কখনোই বাঘ থেকে হাতী তৈরী করা সম্ভব না। তাই বিবর্তনবাদ অনুযায়ী, সরীসৃপ থেকে পাখির উদ্ভবের ঘটনাটি অবৈজ্ঞানিক।

যুক্তি নং ৬: নৃতত্ত্ববিদরা মানুষের উৎপত্তির ধারাকে চারটি ভাগে ভাগ করেন। এগুলো হলঃ অস্ট্রালোপিথেকাস, হোমো ইরেকটাস হোমোএভিলাস এবং হোমোসেপিয়েনস। বিবর্তনবাদের সাথে এই স্তরগুলোর কোন মিল নেই যা এর অগ্রহণযোগ্যতার একটি কারণ।

যুক্তি নং ৭: সম্প্রতি নাসা থেকে দুটি মহাকাশ যান পাঠানো হয় মঙ্গল গ্রহে। সেখানে পানির উপস্থিতি দেখা যায়। কিন্তু সেখানে কোন জীবনের উৎপত্তি হয় নি। বিবর্তনবাদ অনুযায়ী, যেহেতু সেখানে জীবনের উৎপত্তি হওয়ার পরিবেশ ছিল সেখানে প্রাকৃতিক নিয়মে জীবনের বিকাশ ঘটার কথা। এর কারণ হল, বিবর্তনবাদ বলতে আসলে কিছু নেই। প্রত্যেকটি জিনিসই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়।

যুক্তি নং ৮:  বিবর্তনবাদকে যারা সমর্থন করেন তারা ফসিল ( Fossil)  গুলো থেকে যুক্তি দেখান। মানুষ ও Primate  গোত্রের প্রাণীদের Skull গুলো নিয়ে সাদৃশ্য খুঁজে বের করে তারা মানুষের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তাই আজ তারা সবচেয়ে বড় প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন কেননা জিরাফ এবং জেব্রার মত প্রাণীদের ক্ষেত্রে এ ফসিলগুলো উপর্যুক্ত সত্যতা প্রমাণ করে না। অন্য কোন প্রাণীদের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য পাওয়া যায় নি।

যুক্তি নং ৯:  বিবর্তবাদ অনুযায়ী প্রতিকূল পরিবেশে টিকে যাকার জন্য প্রাণীদের দৈহিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে এবং জীবটি তার নিজস্বতা হারিয়ে অন্য একটি প্রজাতিতে পরিণত হয়। আজকের বিজ্ঞান বলে পরিবেশের সাথে সাথে জীবরে কিছু জীনগত পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে জীবটির কিছু বৈশিষ্ট্যর পরিবর্তন ঘটে কিন্তু কখনোই জীবটি অন্য প্রজাতির আরেকটি জীবে পরিণত হয় না। এটি ‘Genetics’ এর একটি শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক সত্য। তাই বিবর্তনবাদ আজ তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন। নোবেল বিজয়ী কয়েকশ বিজ্ঞানী আছেন যারা বিবর্তনবাদকে সমর্থন করেন নি। স্যার ওয়াটসন ও ক্রীক তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

যুক্তি নং ১০: বিবর্তনবাদ যদি সত্যই হবে তবে বর্তমান একজন মানব শিশুকে মানব পরিবেশ হতে সম্পূর্ন পৃথক করে বনজ পরিবেশে আর একটি বানরকে মানব পরিবেশে আনলেতো অভিযোজন প্রক্রিয়ার ফলে মানব শিশু বানরে আর বানর মানবে পরিনত হবার কথা । কিন্তু তা চিরকাল অসম্ভব যা বুঝিয়ে দেয় যে ডারউইনের বিবর্তনবাদ একটি মিথ্যা যুক্তি ।

 যুক্তি নং ১১: যারা বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করেন তাদের জন্য আর একটি প্রশ্ন যে একটি মাত্র কোষ থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট আজকের এই জটিল মহাবিশ্বের সকল । ঠিক সেই কোষটির সৃষ্টিকর্তা কে ? কোথা থেকে পেল তার বিভাজন ক্ষমতা ? সেটার কি জীবন আর বিবেক ছিল ? সেটা কোন পরিবেশে ছিল ? কে প্রথম ঐ কোষটি প্রকৃতিক ভাবে নির্বাচন করেছিলেন ?
যুক্তি নং ১২: আমরা যে কাগজে লিখি তার উৎস কি? এর উৎস গাছ। যদি কেউ বলে, অনেক বছর পূর্বে প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কারণে গাছ থেকে কাগজের উৎপত্তি হয় এবং সেই কাগজে তৈরী হয় খাতা তা কি আপনি বিশ্বাস করবেন? কখনোই না, কারণ একটি ছোট শিশু ও বুঝতে পারে কাগজ কারখানাতে কারিগরের পরিশ্রমে তৈরী হয়। তাই আজকের এ জীবজগৎ হঠ্যাৎ করে সৃষ্টি তা মানা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক।

মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। তার উৎপত্তি বানর থেকে হতে পারে না। যদি তাই হয় তবে মানুষের আধ্যাতিক ও পারলৌকিক জীবন, তার আবেগ, অনুভূতি, সমাজ রাষ্ট্র সব কিছুই অর্থহীন। বিবর্তনবাদ কোনো বৈজ্ঞানিক সত্য নয়। এটি এখনোও একটি তত্ত্ব। এর সাহায্যে প্রজনন তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করা সহজ তাই এখনো ও অনেকে এটিকে ব্যবহার করে থাকেন। বিজ্ঞান যতই অগ্রসর হচ্ছে বিবর্তনবাদ ততই অকেজো হয়ে পড়ছে। একদিন বিজ্ঞান মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিবে। মানুষ জানতে পারবে তার অস্বিত্ব কিভাবে এল।

http://anukgc.blogspot.com/?m=1






নানা রকমের সময় | শুভাশীষ চিরকল্যাণ পাত্র



স্থানীয় সময়, স্থানীয় মধ্য সময়, প্রমাণ সময় ইত্যাদি বিষয়গুলির ঠিকঠাক সংজ্ঞা ভূগোল বইগুলিতে পাওয়া যায় না। এ নিয়ে অনেকের নানা অসম্পূর্ণ ও ভুল ধারণা আছে বলে আমি লক্ষ করেছি। যেমন ধরুন কেউ কেউ মনে করেন যে গ্রীণিচের স্থানীয় সময়কে গ্রীণিচের মধ্য সময় বা GMT (Greenwich mean time) বলে। আসলে কিন্তু তা নয়। ওরা 'Greenwich mean time' শব্দগুচ্ছে mean শব্দটির তাৎপর্য্য না বুঝে বিষয়টি ভুল বুঝে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে গ্রীণিচের স্থানীয় মধ্যসময়কে GMT বলে (স্থানীয় সময়কে নয়)। বর্ত্তমান নিবন্ধে এই বিষয়গুলি আলোচনা করছি, যা ভূগোলের শিক্ষকশিক্ষিকা ও ছাত্রদের এবং আগ্রহী সকলের খুব কাজে লাগবে বলে আমি আশা করি। এখানে আপাত সূর্য্য (apparent sun), মধ্যসূর্য্য (astronomical mean sun), স্থানীয় সময় (local time), মধ্যসময় (local mean time), কাল সমীকরণ (local mean time) ইত্যাদি বিষয়গুলির কথা আলোচনা করা হবে।

কোনো স্থানে সূর্য্যঘড়ি যে সময় দেয় তাকে ঐ স্থানের স্থানীয় সময় (local time) বলে। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা হিসাবে সূর্য্য খুব একটা ভাল নয়। সূর্য্যঘড়ি সারা বছর ঠিক সময় দেয় না। একটা সংশোধনের দরকার হয়। ঐসংশোধনটা কবে কত (সূর্যঘড়ি কতটা স্লো বা কতটা ফাস্ট) তার গাণিতিক হিসাব আছে। প্রশ্ন: ঋতুভেদে দিনরাত্রির হ্রাসবৃদ্ধি হয়, কিন্তু দিনরাত্রি মিলে সর্বদা ২৪ ঘণ্টাই থাকে কি? যদি তা থাকত, অর্থাৎ সূর্য যদি বছরের প্রতিদিনই ঠিক ২৪ ঘণ্টায় এক পাক খেত (আপাত), তাহলে ঋতুভেদে সূর্যঘড়িতে কোনো পরিবর্তন দরকার হত না। কিন্তু সৌরদিন সর্বদা সমান (২৪ ঘণ্টা) থাক না — কখনো একটু বেশী, কখনো একটু কম হয়। বছরের নানা তারিখে সৌরদিনের মান দেখুন:

 তারিখ সৌরদিন 
 ১লা জানুয়ারী ২৪ ঘণ্টা - ২৫.৩ সেকেণ্ড ( - মানে 'মাইনাস')
 ১৫ই ফেব্রুয়ারী  ২৪ ঘণ্টা -২.৮ সেকেণ্ড 
 ১লা এপ্রিল ২৪ ঘণ্টা -১৭.৯ সেকেণ্ড
 ১লা জুলাই  ২৪ ঘণ্টা -১১.৬ সেকেণ্ড
 ১৫ই সেপ্টেম্বর  ২৪ ঘণ্টা +১৮.৯ সেকেণ্ড
 ১৫ই অক্টোবর  ২৪ ঘণ্টা +১৩.৪ সেকেণ্ড
 ১লা নভেম্বর  ২৪ ঘণ্টা +১.৭ সেকেণ্ড
 ১৫ই ডিসেম্বর  ২৪ ঘণ্টা +২৮.৮ সেকেণ্ড

তালিকায় দখছেন ১লা জানুয়ারী সেৌরদিন ২৪ ঘণ্টার চয়ে ২৫.৩ সেকেণ্ড কম, ১৫ই অক্টোবর ২৪ ঘণ্টার চেয়ে ১৩.৪ সেকেণ্ড বেশী। সৌরদিনের গড় মান ২৪ ঘণ্টা। কিন্তু সারা বছর ধ'রে সেৌরদিনর মান কিছুটা বাড়া-কমা করে (সৌরদিনর সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মানের পার্থক্য প্রায় ৫৭ সেকেণ্ড)। এই বাড়া-কমার কারণ কী? পৃথিবী কি নিজ অক্ষে কখনো ধীরে, কখনো দ্রুত ঘোরে? না, তা নয়। পৃথিবীর অক্ষাবর্তন যথেষ্ট নিয়মিত। কিন্তু পৃথিবীতে দিনরাত্রির আবর্তনে আহ্নিকগতি  ছাড়া পৃথিবীর বার্ষিকগতিরও একটু প্রভাব আছে। সেটা সারা বছর সমান নয়। পৃথিবী উপবৃত্তাকার পথে সূর্য্যের চারদিকে ঘোরে। কক্ষপথের সব জায়গায় পৃথিবীর বেগ সমান থাকে না। এর ফলেই সারা বছর জুড়ে সেৌরদিনের একটু বাড়া-কমা হয়।

আকাশে সূর্যের দৈনিক আবর্তন সম্পূর্ণ নিয়মিত নয় — সূর্য কখনো একটু স্লো, কখনো একটু ফাস্ট ঘোরে। ঘড়ির কাঁটা হিসাবে সূর্য আদর্শ নয়। সূর্য্যঘড়ির এই অসুবিধা এড়াতে একটা কাল্পনিক সূর্যের কথা ভাবা হয় যা সর্বদাই ঠিক ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীকে এক পাক খায়। একে মধ্য সূর্য্য (astronomical mean sun) বলে। সূর্যঘড়ি অনুযায়ী যে সময় তাকে স্থানীয় সময় (local time) এবং মধ্য সূর্য্য অনুযায়ী যে সময় তাকে স্থানীয় মধ্য সময় (local mean time) বলে। আমাদের হাতঘড়িগুলি চলে মধ্য সময় অনুযায়ী।

স্থানীয় সময় থেকে স্থানীয় মধ্য সময়কে বিয়োগ করলে বিয়োগ ফলকে কাল সমীকরণ (equation of time) বলে। অর্থাৎ, কাল সমীকরণ = স্থানীয় সময় (সূর্য্যঘড়ির সময়) - স্থানীয় মধ্য সময়। বা, স্থানীয় মধ্য সময় = স্থানীয় সময় (সূর্য্যঘড়ির সময়) - কাল সমীকরণ। কাল সমীকরণের মান বছরের কবে কত তার একটা তালিকা দিই:

 তারিখ          কাল সমীকরণ           
 ০১ Jan         -০৩ মি. ৪৫ সে.   ( - মানে 'মাইনাস')
 ১৫ Jan         -০৯ মি. ৩৪ সে.         
 ০১ Feb          -১৩ মি. ৩৮ সে.         
 ১৫ Feb          -১৪ মি. ৭ সে.           
 ০১ Mar          -১২ মি. ২১ সে.         
 ১৫ Mar          -০৮ মি. ৫১ সে. 
 ০১ Apr          -০৩ মি. ৪৮ সে. 
 ১৫ Apr         -০২ সে.                     
 ০১ May       -০২ মি. ৫৭ সে. 
 ১৫ May       -০৩ মি. ৪০ সে. 
 ০১ June       -০২ মি. ৯ সে. 
 ১৫ June        -৩১সে.
০১ Jul          -০৩ মি. ৫৩ সে.
১৫ Jul          -০৫ মি. ৫৯ সে.
০১ Aug      -০৬ মি. ১৮ সে.
১৫ Aug         -০৪ মি. ২৪ সে.
০১ Sep         +০৬ সে.
১৫ Sep         +০৪ মি. ৫৫ সে.
০১ Oct         +১০ মি. ২৬ সে.
১৫ Oct       +১৪ মি. ১৭ সে.
০১Nov          +১৬ মি. ২৪ সে.
১৫ Nov     +১৫ মি. ২০ সে.
০১ Dec      +১০ মি. ৫০ সে.                 
১৫ Dec      +০৪ মি. ৪১ সে.

কাল সমীকরণ হচ্ছে সূর্য্যঘড়ি বছরের কবে কতটা স্লো বা ফাস্ট যায় তার হিসাব। ফেব্রুয়ারী মাসে সূর্য্যঘড়ি প্রায় ১৪ মিনিট স্লো যায়, তখন সূর্যঘড়ির সময়ের সঙ্গে ১৪ মিনিট যোগ করলে তবে স্থানীয় মধ্য সময় পাওয়া যাবে। মে মাসে সূর্যঘড়ি ৩-৪ মিনিট ফাস্ট যায়, তখন সূর্য্যঘড়ির সময় থেকে ঐ ৩-৪ মিনিট বিয়োগ করলে স্থানীয় মধ্য সময় পাওয়া যাবে। উপরের তালিকায় সূর্য্যঘড়ি স্লো গেলে কাল সমীকরণকে ঋণাত্মক এবং ফাস্ট গেলে কাল সমীকরণকে ধনাত্মক ধরা হয়েছে। সূর্যঘড়ির সময় থেকে কাল সমীকরণকে বীজগাণিতিক প্রথায় বিয়োগ করলে স্থানীয় মধ্য সময় পাওয়া যায়। ১৬ই এপ্রিল, ১৪ই জুন, ১লা সেপ্টেম্বর, ২৫শে ডিসেম্বর — এই চারটি দিনে কাল সমীকরণের মান প্রায় শূন্য। এই দিনগুলিতে স্থানীয় সময় ও স্থানীয় মধ্য সময় একই। এই দিনগুলিতে সূর্য (বাস্তব সূর্য্য) এবং মধ্য সূর্য্য একই সঙ্গে মধ্যরেখা অতিক্রম করে। বছরের বিভিন্ন তারিখে কাল সমীকরণের মান নিয়ে একটি লেখচিত্র অঙ্কন করলে কেমন হবে তা সঙ্গের ছবিতে দেখানো হয়েছে।

সূর্য্যঘড়ির সময় থেকে ভারতীয় প্রমাণ সময় কী ক'রে বের করা যায় তা বলি। সূর্য্যঘড়ির সময় দেখুন (এটি আপনার স্থানের স্থানীয় সময়)। আপনার স্থানটি এলাহাবাদের পূর্বদিকে হলে প্রতি ডিগ্রী দ্রাঘিমার পার্থক্যের জন্য সূর্যঘড়ির সময় থেকে ৪ মিনিট সময় বিয়োগ করুন, স্থানটি এলাহাবাদের পশ্চিমে হলে ঐসময়টা যোগ করুন। পেলেন এলাহাবাদের স্থানীয় সময়। এলাহাবাদের স্থানীয় সময় থেকে ঐদিনের কাল সমীকরণ বিয়োগ করলে পাবেন এলাহাবাদের স্থানীয় মধ্য সময় বা ভারতের প্রমাণ সময়।

পূর্ব-পশ্চিমে ভারতের বিস্তৃতি ৬৮°৭′ পূর্ব দ্রাঘিমা (অরুণাচলের পূর্ব সীমান্ত) থেকে ৯৭°২৫′ পূর্ব দ্রাঘিমা (গুজরাটের পশ্চিম সীমান্ত) পর্যন্ত। দুই দ্রাঘিমার পার্থক্য ২৯°১৮′ বা প্রায় ৩০°। ১° দ্রাঘিমার পার্থক্যে সময়ের পার্থক্য হয় প্রায় ৪ মিনিট। তাহলে ৩০° দ্রাঘিমার পার্থক্যে সময়ের পার্থক্য প্রায় ১২০ মিনিট বা ২ ঘণ্টা। অরুণাচলে যখন সূর্য্য অস্ত যায় গুজরাটে তার প্রায় ঘণ্টা দু'য়েক পরে অস্ত যায়। পূর্ব-পশ্চিমে ভারতের প্রায় মাঝখানে অবস্থিত এলাহাবাদের শহরের (৮২.৫° পূর্ব দ্রাঘিমা) স্থানীয় মধ্য সময় অনুযায়ী সারা ভারতের রেল, ডাক, বেতার এবং প্রশাসনিক কাজকর্ম ইত্যাদি চালানো হয়। এলাহাবাদের স্থানীয় মধ্য সময়কে ভারতের প্রমাণ সময় বলে।

আশা করি এখন বিষয়গুলি আপনাদের কাছে পরিষ্কার হল। সকলকে ধন্যবাদ।

সূর্য্য ও চাঁদের দূরত্ব ও আকার এবং সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্ব | শুভাশীষ চিরকল্যাণ পাত্র



সূর্য্য ও চাঁদের দূরত্ব ও আকার এবং সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্ব বিষয়ে সামোসের অ্যারিস্টার্কাসের গবেষণা

খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে সামোসের অ্যারিস্টার্কাস (৩১০-২৩০ খ্রীঃপূঃ) অর্ধচন্দ্র ও সূর্য্যের কৌণিক দূরত্বের পরিমাপ করে এবং চন্দ্রগ্রহণের স্থায়িত্ব থেকে পৃথিবী থেকে সূর্য্য ও চাঁদের দূরত্বের অনুপাত এবং এই তিনি জ্যোতিষ্কের ব্যাসের অনুপাত নির্ণয় করেন। তাঁর পদ্ধতিটা খুবই সহজ। তবে তাঁর পরিমাপে কিছুটা ভুল হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন সূর্য্য চাঁদের ১৯ গুণ দূরে আর তার ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ৬.৭ গুণ। আজকের দিনে আমরা জানি যে সূর্য্য চাঁদের চেয়ে প্রায় ৪০০ গুণ দূরে আর তার ব্যাস পৃথিবীর প্রায় ১১০গুণ (চাঁদের ব্য়াসের প্রায় ৪০০ গুণ)। পরিমাপে ভুল করলেও সূর্য যে পৃথিবীর চেয়ে অনেক গুণ বড়, তা তিনি প্রমাণ করেছিলেন। তাঁর গবেষণার ফলাফল ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বে তাঁর অনাস্থা এনে দেয়। সূর্য এত বড়, পৃথিবী এত ছোট — তাহলে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরবে কী ক'রে? তাঁর সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হল একটা বড় বস্তুর চারদিকেই একটা ছোটো বস্তুর ঘোরা উচিত। তখন তিনি বললেন যে আকাশের বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনির মতো পৃথিবীও একটি গ্রহ আর সব গ্রহই আসলে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। এছাড়া পৃথিবীর নিজ অক্ষে আবর্তনের কথাও তিনি বলেছিলেন। কোপার্নিকাসের বহু (প্রায় ১৮০০ বছর) আগে সৌরজগতের সম্পূর্ণ তত্ত্বটাই তিনি উপস্থাপন করেছিলেন। তবে প্রাচীনকালের মানুষ তাঁর কথা মানেনি।

অ্য়ারিস্টার্কাস কী করে সূর্য্য ও তাঁদের দূরত্বের অনুপাত বের করেছিলেন তা বুঝতে গেলে সঙ্গের ছবি দেখুন। অর্ধচন্দ্র সূর্যের সঙ্গে নিঁখুত সমকোণ করে না, কোণটার মান ৯০° অপেক্ষা কিছু কম। কতটা কম? সেটাই আপনাকে মেপে দেখতে হবে। তাহলেই বের করতে পারবেন সূর্য চাঁদের কতগুণ দূরে। ছবিতে চাঁদের CD ব্যাসটা বাড়িয়ে দিলে পৃথিবীতে পৌঁছাচ্ছে। AB ব্যাসটা তার সমকোণে, সেটা বাড়িয়ে দিলে সূর্যে পৌঁছায়। আপনি পৃথিবী থকে চাঁদের ADB  অর্ধাংশকে দেখতে পাবেন। সেটা একটা অর্ধ গোলক। সূর্যের আলো পড়ছে চাঁদের CBD অর্ধ গোলকে। পৃথিবী থেকে আপনি যে ADB  অংশ দেখছেন তার শুধু ODB  অংশ আলোকিত। AOD অংশে আলো পড়ছে না। ফলে আপনি যতটা দেখছেন তার পূর্বের অর্ধাংশ AOD  কালো আর পশ্চিমের অর্ধাংশ BOD আলোকিত। এজন্য আপনি দেখবেন আধখানা চাঁদ। ঐ অর্ধেন্দু কিন্তু আসলে চাঁদের গোলকের এক-চতুর্থাংশ। অতদূরে দৃষ্টির গভীরতা  কাজ করে না বলেই অমন (অর্ধবৃত্তাকার চাকতির মতো) দেখায়। ছবিতে চাঁদের কলা ½ (অর্ধচন্দ্র) বলে AB ও CD পরস্পর লম্ব।  AB সূর্যে পৌঁছায়, CD পৃথিবীতে। D বিন্দু ADB চাপটির মধ্য বিন্দু হবে। তাই ∠EOS=৯০°। অতএব ∠AES-এর মান ৯০° অপেক্ষা কম হবে। কারণ ত্রিভুজের তিনটি কোণের সমষ্টি ১৮০°। সূর্যের দূরত্ব অসীম নয় বলে ∠ESO-র মান শূন্য হতে পারে না। পৃথিবী থেকে সূর্যকে দেখি ES রেখায়, চাঁদকে EO রেখায়। সূর্য ও চাঁদের কৌণিক ব্যবধান তাই ∠OES, এই কোণটা ৯০° অপেক্ষা কম। পর্যবেক্ষণে পাওয়া যায় ∠OES-এর মান প্রায় ৮৯পূর্ণ৬/৭°। আমাদের চাই সূর্য ও চাঁদের দূরত্বের অনুপাত, অর্থাৎ ES/EO । কী ক'রে সেটা পাব? খুব সহজ: △EOS আঁকুন যাতে ∠SOE=৯০°, ∠SEO= ৮৯পূর্ণ৬/৭° (প্রায়) এবং∠ESO= ⅐°(প্রায়) হয়। ES এবং EO-এর দৈর্ঘ্য স্কেল দিয়ে মেপে নিয়ে ভাগ ক'রে ফেলুন, তাহলেই হল। ত্রিভুজটা বড় আঁকুন, ছোটো আঁকুন তাতে কোন অসুবিধা নেই; যদি কোণগুলি একই থাকে তবে ES/EO-এর মান সর্বদা একই পাবেন। এর কারণ সদৃশকোণী ত্রিভুজের অনুরূপ বাহুগুলি সমানুপাতিক। অবশ্য আপনাকে বডে়া করেই ত্রিভুজটা আঁকতে হবে। তাছাড়া  ⅐° কোণ আঁকা সহজ নয়। ES/EO  হচ্ছে ∠ESO (=⅐°)–এর সাপেক্ষে অতিভুজ ও লম্বের অনুপাত। ত্রিকোণমিতিতে একে বলে cosec ⅐°। ত্রিকোণমিতির তালিকা থেকে পাওয়া যায় cosec⅐°=৪০০ (চার শত, প্রায়)। অর্থাৎ সূর্য চাঁদের ৪০০ (চার শত) গুণ দূরে। ত্রিকোণমিতি জানলে আপনাকে বিরাট ত্রিভুজ অঙ্কন ক'রে মাপজোক করতে হবে না। ত্রিকোণমিতিক তালিকা দেখেই উত্তরটা পেয়ে যাবেন।

অর্ধচন্দ্র যে সূর্যের সঙ্গে 89⁶/₇° (৮৯পূর্ণ৬/৭°)কোণ ক'রে থাকে (পৃথিবীতে বা আপনার চোখে) সেটা মাপবেন কী ক'রে? মাপা যায়, তার অনেক উপায় আছে। প্রাচীনকালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নিজের হাতে কোণ মাপার যন্ত্র তৈরী করতেন। আজকাল অনেক ভাল ভাল সেক্সট্যাণ্ট যন্ত্র পাওয়া যায়। অ্যারিস্টার্কাস যে কী কায়দায় ঐকোণটা মেপেছিলেন তা আমার জানা নেই। আর একটা অসুবিধা আছে। চাঁদ যে কখন আধখানা হল তা বুঝবেন কী ক'রে? আলো-আঁধারের সংযোগস্থল ঠিক কখন সরলরেখা হল, খালি চোখে তার সঠিক সময়টা বোঝা কষ্টকর। দূরবীণে আরো সহজে বোঝা যায়। অ্যারিস্টার্কাসের ভুলটা এখানেই হয়েছিল। তিনি সূর্য ও অর্ধচন্দে্রর মধ্যবর্তী কোণটা ৮৯পূর্ণ৬/৭°-এর বদলে পেয়েছিলেন ৮৭°। তাই তিনি বলেছিলেন সূর্য চাঁদের ১৯ গুণ দূরে (আসলে ৪০০গুণ হবে)।

সূর্য ও চাঁদের দূরত্বের অনুপাত ৪০০ বলে তো জানলাম, তাদের ব্যাসের অনুপাত কত? খুব সহজ, সূর্যের ব্যাসও চাঁদের ব্যাসের ৪০০ গুণ। কারণ আকাশে চাঁদ ও সূর্য উভয়ের চাকতিই সমান মাপের দেখায়। সূর্যের ব্যাস চাঁদের ৪০০ গুণ এবং দূরত্বও ৪০০ গুণ, তাই সূর্যকে চাঁদের সমান দেখায় (প্রায়)। চাঁদ ও সূর্যের চাকতি যে প্রায় সমান আকারেরই দেখায় তা বুঝবেন কী ক'রে? ভেবে দেখুন, চাঁদের চাকতি সূর্যের চাকতির চেয়ে ছোটো হলে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় তা পুরো সূর্যকে অল্প সময়ের জন্য (বড়জোর কয়েক মিনিট) ঢেকে দেয় কী ক'রে? মাঝে মাঝে আবার বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়, তখন গ্রহণগ্রস্ত সূর্যের একেবারে কিনারার দিকে আলো থাকে। তখন চাঁদের চাকতি সূর্যের চাকতির চেয়ে একটুখানি ছোটো থাকে বলে চঁাদ সূর্যকে সম্পূর্ণ ঢাকতে পারে না, কিনারায় বলয়ের মতো একটু সরু আলোকিত ফালি থেকে যায়। পৃথিবী থেকে সূর্য বা চাঁদ কারও দূরত্বই সর্বদা সমান থাকে না। তাই তাদের চাকতিগুলির ব্যাস সর্বদা সমান দেখায় না। কিন্তু পৃথিবী থেকে তাদের আপাত আকারটা গড়ে আমরা প্রায় সমান সমানই দেখি। মাপজোক ক'রেও এটা প্রমাণ করা যায়। চাঁদের চাকতির একটি ব্যাসের দু'টি প্রান্ত থেকে আপনার চোখ পর্যন্ত দু'টি রেখা টানলে তারা প্রায় ½° কোণ তৈরী করে। একে বলে চাঁদের কৌণিক ব্যাস। সূর্যের কৌণিক ব্যাসও ½° (প্রায়)।

এখন প্রশ্ন: অ্যারিস্টার্কাস কী করে সূর্য্য, চাঁদ ও পৃথিবীর ব্যাসের অনুপাত মাপলেন? চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়ে। সেই ছায়ার ব্যাস মেপে আমরা সূর্য ও পৃথিবীর ব্যাসের অনুপাত জানতে পারি, কারণ পৃথিবী থেকে সূর্য ও চাঁদের দূরত্বের অনুপাতটা আমাদের জানা।পৃথিবীর ছায়াটা শঙ্কুর মতো সরু হয়ে মিলিয়ে যায়, তার কারণ সূর্য পৃথিবীর চেয়ে বড়। তা না হলে ছায়াটা ক্রমাগত সরু হওয়ার পরিবর্তে উল্টানো শঙ্কুর মতো মোটা হতে থাকত। তাহলে পৃথিবী নয়, সূর্যই বড়। কতগুণ বড়? সেটা বের করতে গেলে চাঁদের দূরত্বে পৃথিবীর ছায়া চাকতির কৌণিক ব্যাস জানতে হবে। চন্দ্রগ্রহণের স্থায়িত্ব থেকে সেটা জানা যেতে পারে।
চাঁদর কৌণিক ব্যাস ½°। চাঁদর দূরত্বে পৃথিবীর ছায়ার কৌণিক ব্যাস, ধরুন, x°। ছায়াটা আর চাঁদ যদি পরস্পরক মাঝ বরাবর অতিক্রম করে তবেই গ্রহণের স্থায়িত্ব সবচেয়ে বেশী হবে। আমরা আকাশে সূর্য্যকে (ও তার উল্টাদিকে পৃথিবীর ছায়াকেও) ঘণ্টায় ১৫° এবং চাঁদকে ঘণ্টায় ১৪.৫° করে ঘুরতে দেখি। তাহলে চাঁদের দিকে পৃথিবীর ছায়াটা ঘণ্টায় (১৫°-১৪.৫°) বা ½° ক'রে এগোয়। যদি পৃথিবীর ছায়া এবং চন্দ্রবিম্ব কেন্দ্র বরাবর পরস্পরকে অতিক্রম করে তাহলে পৃথিবীর ছায়াকে নিজের ও চাঁদের ব্যাসের যোগফলের সমান (½°+x°) পথ অতিক্রম করতে হবে। পৃথিবীর ছায়া চাঁদের দিকে প্রতি ঘণ্টায় ½° এগিয়ে যায়। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে চন্দ্রগ্রহণ সর্বোচ্চ পৌনে চার ঘণ্টা (৩.৭৫ ঘণ্টা) পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তার অর্থ ছায়াটা মোট ½°x৩.৭৫ বা, ১.৮৭৫° যায়। এর থেকে চাঁদের চাকতির ব্যাস ½° বাদ দিলে বাকী (১.৮৭৫-½°) বা ১.৩৭৫° হল পৃথিবীর ছায়ার ব্যাস। এই ব্যাস চাঁদের ব্যাসের ১.৩৭৫/½ বা ২.৭ গুণ (প্রায়)। মানে চাঁদের দূরত্বে পৃথিবীর ছায়ার ব্যাস চাঁদের ব্যাসের ২.৭ গুণ। এবার সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর কতগুণ তা সহজ অঙ্ক কষেই বের করা যায়। আপনারা সে অঙ্ক কষার চেষ্টা করতে পারেন (না পারলে বর্ত্তমান লেখকের 'প্রাথমিক জ্য়োতির্বিজ্ঞান' গ্রন্থ দেখতে পারেন)। অঙ্ক কষে দেখুন যে, সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ১১০ গুণ। আয়তন ব্যাসের ঘনের সমানুপাতিক বলে সূর্যের আয়তন পৃথিবীর আয়তনের ১১০-এর ঘন বা প্রায় ১৩,০০,০০০ গুণ হবে। অর্থাৎ, সূর্যের পেটে প্রায় তের লক্ষ পৃথিবী এঁটে যাবে!

চাঁদ ও পৃথিবীর ব্যাসের অনুপাত কত? আমরা চাঁদের ব্যাস ১ ধরলে সূর্যের ব্যাস=৪০০। সুতরাং পৃথিবীর ব্যাস=সূর্যের ব্যাসের ১১০ ভাগের এক ভাগ=৪০০/১১০=৩.৬ (প্রায়)। তাহলে পৃথিবীর ব্যাস ও চাঁদের ব্যাসের অনুপাত=৩.৬ঃ১, মানে চাঁদের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের চারভাগের একভাগ প্রায় (তার চেয়ে কিছু বেশী)। অবশ্য বিজ্ঞানীরা আরো ভাল ক'রে হিসাব ক'রে দেখেছেন ৩.৬-এর চেয়ে ৩.৭ সংখ্যাটাই আরও সঠিক। তাহলে পৃথিবীর আয়তন চাঁদের (৩.৭)-এর ঘন বা ৫০ গুণ (প্রায়)।

অ্যারিস্টার্কাসের হিসাবে অবশ্য চাঁদের দূরত্বে পৃথিবীর ছায়ার ব্যাস চাঁদের দ্বিগুণ। আর তিনি তাঁর হিসাবে সূর্যের দূরত্ব চাঁদের দূরত্বের ১৯ গুণ পেয়েছিলেন। সেই মতো তিনি বলেছিলেন সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ৬.৭ গুণ এবং আয়তন পৃথিবীর আয়তনের ৬.৭-এর ঘন বা ৩০০ গুণ (প্রায়)। পরিমাপে ভুল হলেও তাঁর পদ্ধতিটা সঠিক, এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। তাঁর পদ্ধতি অবলম্বন ক'রে আজকের দিনে আমরা সঠিক পরিমাপ পেতে পারি।

সূর্য যখন পৃথিবীর চেয়ে অত বড় তখন পৃথিবীর চারদিকে সূর্য না ঘুরে সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘোরাটাই তাঁর স্বাভাবিক বলে মনে হল। বুধ আর শুক্র যে সূর্যের চারদিকে ঘোরে সেকথা আগেই বলে গিয়েছিলেন পন্টুসের হেরাক্লিদেস (৩৮৮-৩১৫ খ্রীঃপূঃ)। হেরাক্লিদেস আরো বলেছিলেন তারায় ভরা আকাশ নয়, পৃথিবীটাই পশ্চিম থেকে পূর্বে রোজ এক পাক ক'রে আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবী থেকে ধ্রুবতারা পর্যন্ত রেখাটাকে অক্ষ ক'রে। এরই ফলে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারার প্রত্যহ পূর্ব থেকে পশ্চিমে গতি লক্ষ্য করা যায়। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর বার্ষিক গতির কথা অবশ্য হেরাক্লিদেসের মাথায় আসেনি। সেটা এল অ্যারিস্টার্কাসের মাথায়। তিনি বিশ্বজগতের কেন্দ্র থেকে পৃথিবীকে হটিয়ে সেখানে সূর্যকে বসালেন। বললেন বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি সবাই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। আর আকাশের তারারা আছে সেখান থেকে বহু গুণ দূরে। সেইসঙ্গে হেরাক্লিডিস উদ্ভাবিত পৃথিবীর আহ্নিক গতির কথাও তিনি স্বীকার ক'রে নিলেন। এই আহ্নিক গতির জন্যই সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-তারার দৈনিক উদয়-অস্ত হয়। আর বার্ষিক গতির জন্য কী হয়? সেজন্য তারাদের পটভূমিতে সূর্যকে রোজ প্রায় ১° ক'রে পশ্চিম থেকে পূর্বে সরে যেতে দেখি। পৃথিবী তার কক্ষপথে পশ্চিম থেকে পূর্বে যত ঘুরবে, সূর্যকে তত পশ্চিম থেকে পূর্বে এক তারা ছেড়ে অন্য তারায় আসতে দেখা যাবে। এক বছর পরে সে আবার ফিরে আসবে আগের তারাটির পাশে। তারারা যে সূর্যের চেয়ে বেশী দূরে তা কিন্তু খালি চোখে আমরা বুঝতে পারি না। এর কারণ আমাদের দৃষ্টির গভীরতা অত দূরে কাজ করে না। পৃথিবী থেকে দেখে মনে হয় চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা সবাই সমান দূরে, তাই আকাশটা একটা ফাঁকা গোলকের মতো মনে হয়। আর মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনির রোজ পূর্বে উদয় ও পশ্চিমে অস্ত যাওয়া পশ্চিম থেকে পূর্বে পৃথিবীর অক্ষাবর্তনের ফল। তারা যে সূর্যের চারদিকেও ঘোরে তা বুঝবেন কী ক'রে? সেটা বোঝা যায় তারাও পশ্চিম থেকে পূর্বে একতারা ছেডে় অন্য তারায় আসে বলে। তারাদের পটভূমিতে পশ্চিম থেকে পূর্বে পুরো এক পাক খেতে মঙ্গলের ৬৮৭ দিন, বৃহস্পতির ১২ বছর, শনির ২৯½ বছর লাগে। এই গতি আসলে তাদের সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর চেয়েও দূরে থেকে আবর্তনের ফল। তবে মাঝে মধ্যে গ্রহগুলি পশ্চিম থেকে পূর্বের তারায় না এসে পূর্ব থেকে পশ্চিমের তারার দিকে যায়, একে বলে বক্রগতি। এটা কেন হয়? মঙ্গলের কথা ভাবুন। সূর্যের চারদিকে নিজ নিজ কক্ষে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবী আর মঙ্গল একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর পাশাপাশি এসে পড়ে। তখন অপেক্ষাকৃত দ্রুতগামী পৃথিবী মঙ্গলকে অতিক্রম ক'রে চলে যায়। ফলে পৃথিবী থেকে দেখলে মনে হয় মঙ্গল যেন উল্টা দিকে যাচ্ছে। গ্রহদের বক্রগতির এই ব্যাখ্যা অ্যারিস্টার্কাস কতটা করতে পেরেছিলেন তা আমার জানা নেই। কোপার্নিকাস এই ব্যাখ্যাটা করেছিলেন। গ্রহগুলি পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে ভাবলে কেন তারা পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘুরতে ঘুরতে কখনো কখনো পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাবে এই খামখেয়ালিপনা ব্যাখ্যা করা দুষ্কর।

পৃথিবী যদি সূর্যের চারদিকে ঘোরে তবে সারা বছর জুড়ে নক্ষত্রমণ্ডলগুলির আকৃতিতে একটা পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা উচিত। কালপুরুষের কথা ভাবুন। পৃথিবীর কক্ষপথের বিভিন্ন অবস্থান থেকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে দেখার জন্য সারা বছর তাকে একই রকম দেখার কথা নয়। পৃথিবীর আহ্নিকগতির জন্য যেমন তারাদের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ঘুরতে দেখা যায় তেমনি বার্ষিক গতির জন্যও তো তারাদের একটা গতি লক্ষ্য করা উচিত? পৃথিবীর কক্ষপথের একটা বিন্দু থেকে কালপুরুষকে আজকে যেমন দেখি, এক বছর পর পৃথিবী সেই বিন্দুতে ফিরে এলে তাকে আবার আগের মতোই দেখব কিন্তু ৬ মাস আগে-পরে দেখলেও কালপুরুষকে একই রকম দেখায় কেন? এর উত্তরে অ্যারিস্টার্কাস বললেন যে সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাসের তুলনায় তারাদের দূরত্ব বহুগুণ বেশী। তাই পৃথিবীর বার্ষিকগতির জন্য তারাদের কোনো বার্ষিক লম্বন (পৃথিবীর বার্ষিক গতির জন্য তারাদের ঐগতিটাকে 'বার্ষিক লম্বন' বলে) দেখা যায় না। কক্ষপথে পরিক্রমণরত পৃথিবীকে নিয়ে সূর্য তারাদের দূরতে তুলনায় একটি বিন্দু বিশেষ। এইভাবে তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রসার বহুগুণ বাড়িয়ে দিলেন।

অ্যারিস্টার্কাসের চেয়ে প্রায় ২৩ বছরের ছোটো সমসাময়িক কালের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী আর্কিমিডিস তাঁর বিখ্যাত 'Sand Reckoner' গ্রন্থে অ্যারিস্টার্কাসের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধারণার কথা বলে গেছেন। আর্কিমিডিস তাঁর ঐ বইয়ে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে বালুকণা দিয়ে ভর্তি করতে কতগুলি বালুকণা লাগবে সেই বিশাল সংখ্যাটি হিসাব করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গেই তিনি বলেছিলেন অ্যারিস্টার্কাসের ব্রহ্মাণ্ডের ধারণা। তবু, দুঃখের বিষয়, অার্কিমিডিস অ্যারিস্টার্কাসকে সমর্থন করেননি।

অ্যারিস্টার্কাস তাঁর সমসাময়িক কালের চেয়ে সহস্রাধিক বছর এগিয়ে ছিলেন। তাঁকে বোঝার মতো মানুষ তখন ছিল না। পশ্চিম এশিয়া মাইনরের সমুদ্র উপকূলের কাছে তখনকার দিনের বিখ্যাত নগরী মিলেটাসের সামোস দ্বীপে খ্রীষ্টপূর্ব ৩১০ সালে তাঁর জন্ম। জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র তখন মিলেটাস বা সামোস নয়, গ্রীসের মূল ভূখণ্ডের এথেন্সও নয়, তা তখন চলে গেছে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত গ্রন্থাগারে। সামোস দ্বীপেই জন্ম হয়েছিল বিখ্যাত পণ্ডিত পিথাগোরাসের, তাঁর প্রায় তিন শতাব্দী আগে। অ্যারিস্টার্কাসের প্রায় দুই শতাব্দী আগে মিলেটাসের উত্তরে ক্লাজোমেনায়ে জন্মেছিলেন অ্যানােক্সাগোরাস নামে আর এক পণ্ডিত। পেরিক্লিসের আমলে তিনি এথেন্সে এসেছিলেন। চাঁদের যে নিজস্ব আলো নেই, চাঁদ যে সূর্যালোকে আলোকিত হয় একথা তিনি বলেছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন চন্দ্রকলার কারণ ব্যাখ্যা করার। তিনি আরো বলেছিলেন চাঁদ মৃত্তিকা দিয়ে তৈরী এবং সূর্য একটা বড়, উত্তপ্ত, অগ্নিময় প্রস্তর। বলেছিলেন সূর্য নাকি অনেক বড়, এমনকি সমগ্র পেলপনেসাসের চেয়েও বড়! তখনকার লোকেরা অ্যানােক্সাগোরাসের এইসব কথা মেনে নিতে পারেননি। তখন লোকে ভাবত সূর্য ও চন্দ্র দুই দেবতা বিশেষ। অ্যানােক্সোগোরাস পেরিক্লিসের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক ব্যক্তিত্বে পেরিক্লিস আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু পেরিক্লিসের শত্রুরা অ্যানােক্সাগোরাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। ধর্মবিরুদ্ধ মতবাদ ও নাস্তিকতার অভিযোগে তাঁর কারাদণ্ড হয়েছিল। সম্ভবত পেরিক্লিস কোনোরকমে তাঁকে কারামুক্ত করতে পেরেছিলেন। অ্যানােক্সাগোরাস এথেন্স ত্যাগ ক'রে চলে যান। পরবর্তী কালে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন চাঁদ কেন বাড়েকমে, গ্রহণ কেন হয় তা নিয়ে ভাবার কিছু নেই, ওটা চাঁদের স্বভাব। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের চিন্তায় ছিল প্রধানত নীতিবাদ ও ধর্মের প্রাধান্য। অ্যারিস্টার্কাস জন্মেছিলেন অ্যারিস্টটলের প্রায় ৯৮ বছর পরে। তবু তাঁর সমসাময়িক আলেকজান্দ্রিয়ার বড় বড় পণ্ডিতেরা তাঁর যুগান্তকারী তত্ত্বটিকে সমর্থন করেননি। সেদিনকার চিন্তাবিদেরা তখনো অতটা সাহস অর্জন করতে পারেননি। ক্লিন্থেস নামে সমসাময়িক এক পণ্ডিত বলেছিলেন,“গ্রীকদের কর্তব্য সামোসের অ্যারিস্টার্কাসকে অধর্মের জন্য অভিযুক্ত করা। পর্যবেক্ষণলব্ধ কিছু ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে তিনি কিনা এই মহাবিশ্বের বাসগৃহ পৃথিবীকে বৃত্তপথে চলমান এবং ঘূর্ণায়মান ভেবেছেন !” প্রাচীনকালে শুধু একজন মাত্র পণ্ডিত অ্যারিস্টার্কাসকে সমর্থন করেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি হলেন টাইগ্রিস নদী তীরের সেলেকিউস (জীবনকাল ১৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি)।

সৌরজগৎ নিয়ে অ্যারিস্টার্কাসের বইটি কিন্তু পাওয়া যায়নি। তাঁর শুধু একটি বইই পাওয়া গেছে, সেটির নাম 'সূর্য ও চাঁদের আকার ও দূরত্ব প্রসঙ্গে' (On The Size and Distances of the Sun and the Moon)। এই বইয়ে আছে শুধু চাঁদ ও সূর্যের দূরত্বের অনুপাত এবং সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদের ব্যাসের অনুপাতের আলোচনা। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর বার্ষিকগতির কথা এ বইয়ে নেই। এর কারণ কী? সৌরজগতের তত্ত্ব তিনি যে সত্যি সত্যিই আবিষ্কার করেছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর্কিমিডিস Sand Reckoner নামক বিখ্যাত গ্রন্থে অ্যারিস্টার্কাসের সৌরকন্দ্রিক তত্ত্বের কথা পরিষ্কার বলে গেছেন, এবং এই বিষয়ে আর্কিমিডিসের মতো বিদ্বাণের সাক্ষ্যকে চূড়ান্ত ধরার অসুবিধা নাই।

অ্যারিস্টার্কাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গেলেও বেঁচে আছে তাঁর বিরুদ্ধে বহু পণ্ডিতের সমালোচনা। 'সূর্য ও চাঁদের আকার ও দূরতম প্রসঙ্গে' বইটিতে তিনি কেন ভূকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী মেনে নিয়েছিলেন? অ্যানােক্সাগোরাসের দুর্দশার কথা আমরা জানি। অ্যারিস্টার্কাসের প্রায় ১৯০০ বছর পরে গ্যালিলিওর লা²নার কথাও আমরা জানি। হতে পারে এই ধরণের একটা ভীতি অ্যারিস্টার্কাসকে প্রভাবিত করেছিল। সূর্য ও চাঁদের আকার নির্ণয়ে যে পদ্ধতি তিনি আবিষ্কার করেছিলেন তাতে ভূকেন্দ্রিক ও সৌরকেন্দ্রিক উভয় তত্ত্বেই কাজ চলে। তাই লোকে মেনে নেবে না ভেবে চট ক'রে সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের কথা না বলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেছিলেন। আবার এমনও হতে পারে যে সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের আবিষ্কার তাঁর  'সূর্য ও চাঁদের দূরত্ব ও আকার বিষয়ে' বইটি লেখার পরবর্তী কালের চিন্তা এবং গবেষণার ফল।

কোপার্নিকাস তাঁর সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন ১৫৪৩ সালে। অ্যারিস্টার্কাসের সঙ্গে তাঁর প্রায় ১৮০০ বছরের ব্যবধান। ভাবতে অবাক লাগে অ্যারিস্টার্কাস এত আগে বলে গেলেও গ্রহদের গতিরহস্য পরবর্তী ১৮০০ বছর ধ'রে মানুষ বুঝতে পারেনি! গ্যালিলিও বলেছিলেন যে কোপার্নিকাস সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের আবিষ্কর্তা নন, তিনি প্রাচীনকালের এই বিস্মৃতপ্রায় তত্ত্বটিকে উদ্ধার করেছিলেন। কোপার্নিকাস যখন ইটালীতে ডাক্তারী পড়তে গিয়েছিলেন তখন সদ্য আবিষ্কৃত প্রাচীন গ্রীক পণ্ডিতদের লেখাগুলি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কোপার্নিকাস কিন্তু অ্যারিস্টার্কাসের থেকে নকল করেননি। একটি চিঠিতে কোপার্নিকাস লিখেছেন,“সিসেরোর মতে সাইরাকিউজবাসী হিসেটাস পৃথিবীর গতির কথা বলেছিলেন। প্লুটার্কের মতে প্রাচীনকালে আরো কেউ কেউ এই মতে বিশ্বাসী ছিলেন।” এখানে প্লুটার্ক অ্যারিস্টার্কাসের কথা লিখেছিলেন। কাজেই কোপার্নিকাস অ্যারিস্টার্কাসের তত্ত্বের কথা জানতেন। তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ 'স্বর্গীয় গোলকদের ঘূর্ণন'-এর পাণ্ডুলিপিতে কোপার্নিকাস অ্যারিস্টার্কাসের কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু বইটি ছাপাবার সময় তা বাদ পডে় যায়। অ্যারিস্টার্কাসের প্রায় বিস্মৃত তত্ত্বটির কতটুকু যে কোপার্নিকাসের হাতে পৌঁছেছিল সেটা অবশ্য খুবই সন্দেহজনক। প্রাচীনকালে কারও কারও রচনায় সেৌরকন্দ্রিক তত্ত্বের সমর্থন আছে সেটুকু জেনেই তিনি খুশি ছিলেন। তারপর বহুবছর ধ'রে নানা গাণিতিক হিসাবনিকাশ ক'রে ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বের চেয়ে সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের শ্রেষ্ঠত্ব তিনি প্রমাণ করেছিলেন। কোপার্নিকাস পেয়েছিলেন গ্যালিলিও এবং কেপলারের মতো যোগ্য উত্তরসূরী। সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে কোপার্নিকাস, কেপলার ও গ্যালিলিওর। তবু অ্যারিস্টার্কাসকে আমরা ভুলে যেতে পারি না। তাঁর বুদ্ধি এবং সাহস আমাকে অবাক করে।

ইরাটোস্থেনিস কর্তৃক পৃথিবীর পরিধি নির্ণয় | শুভাশীষ চিরকল্যাণ পাত্র



খ্রীষ্টপূর্ব্ব তৃতীয় শতাব্দীতে গ্রীক পণ্ডিত ইরাটোস্থেনিস কেমন করে পৃথিবীর পরিধি মেপেছিলেন তা এখানে সংক্ষেপে বলব। ইরাটোস্থেনিস (খ্রীঃপূঃ ২৭৩–১৯২) ছিলেন আর্কিমিডিসের ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর চেয়ে ১৩-১৪ বছরের ছোটো। তাঁর কর্মস্থল ছিল মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায়। আলেকজান্দ্রিয়া ছিল তখনকার এক বিখ্যাত নগরী। আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্য তিন সেনাপতির মধ্যে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। মিশর পড়েছিল টলেমির ভাগে। তিনি রাজধানী স্থাপন করেছিলেন মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায়। টলেমি বংশীয় রাজারা বিদ্যার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তাঁদের রাজধানীতে সে যুগের বড় বড় পণ্ডিতদের ডেকে এনেছিলেন। আলেকজান্দ্রিয়ায় গড়ে উঠেছিল এক পৃথিবীবিখ্যাত গ্রন্থাগার। সেই গ্রন্থাগারের প্রধান গ্রন্থাগারিক ছিলেন ইরাটোস্থেনিস। 

পৃথিবীর ব্যাসের তুলনায় সূর্য এত দূরে যে পৃথিবীর সব স্থানে পতিত সৌররশ্মি পরস্পর সমান্তরাল হয়। পৃথিবী সমতল হলে একটা কূয়োর জলে রোদ পড়লে সব কূয়োর জলেই রোদ পড়ত। কিন্তু পৃথিবী গোলকাকার। ইরাটোস্থেনিস লক্ষ্য করেছিলেন যে, সূর্য্যের উত্তরায়নের দিন দুপুরবেলায় সৌররশ্মি কর্কটক্রান্তিরেখার উপর অবস্থিত সীন নামক স্থানের গভীর কূয়োর তলদেশ অবধি পৌঁছায় (জলে রোদ পড়ে) অথচ সেখান থেকে প্রায় ৫০০ মাইল উত্তরে অবস্থিত তাঁর কর্ম্মস্থল আলেকজান্দ্রিয়ার কূয়োর জলে বছরের কোনো দিনই রোদ পড়ে না। এই ঘটনার কারণ কী? এর কারণ হল আলেকজান্দ্রিয়ার কূয়ো আর সীনের কূয়ো পরস্পর সমান্তরাল নয় — কূয়ো দুটি ভূকেন্দ্রে ৭.২° কোণ উৎপন্ন করে (সঙ্গের ছবি দেখুন)। ছবি দেখে বুঝতে পারা যায় ভূগোলকের ৭.২° মাপের একটি চাপের দৈর্ঘ্য ৫০০ মাইল (AS=৫০০ মাইল)। তাহলে সম্পূর্ণ ভূগোলকের পরিধি কত হবে? সেটা ঐকিক নিয়মের অঙ্ক:

 ৭.২° চাপের দৈর্ঘ্য = ৫০০ মাইল।
 বা ১° চাপের দৈর্ঘ্য = ৫০০÷৭.২ মাইল।
 বা ৩৬০° চাপের দৈর্ঘ্য = (৫০০÷৭.২)x৩৬০ মাইল = ২৫০০০ মাইল।

এই হল পৃথিবীর পরিধি। ইরাটোস্থেনিসের মতে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সীনের দূরত্ব ৫০০০ স্টাডিয়া (১ স্টাডিয়া মানে গ্রীকদের একটি স্টেডিয়ামের দৈর্ঘ্য), তাই পৃথিবীর পরিধি = (৩৬০÷৭.২) x৫০০০= ২৫০০০০ স্টাডিয়া। এখন গ্রীকদের একটি স্টেডিয়ামের দৈর্ঘ্য ঠিক কত ছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে। 

পৃথিবীর পরিধি যদি ২৫০০০ মাইল হয় তাহলে তার ব্যাস কত? গোলকের পরিধিকে ৩.১৪ দিয়ে ভাগ করলে তার ব্যাস পাওয়া যায়। তাহলে পৃথিবীর ব্যাস = (২৫০০০÷৩.১৪) মাইল = ৭৯৬১ মাইল (প্রায়)। মনে রাখুন পৃথিবীর ব্যাস মোটামুটি ৮০০০ মাইল। তাহলে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ প্রায় ৪০০০ মাইল। যদি আরো সঠিক জানতে চান তো বলি পৃথিবীর ব্যাসার্ধের অধুনা নির্ণীত মান ৩৯৫৯ মাইল।

প্রশ্ন: আলেকজান্দ্রিয়ার কূয়া আর সীনের কূয়ার ভিতরের কোণটার মান যে ৭.২° ইরাটোস্থেনিস তা কী করে জেনেছিলেন? উত্তরে বলি যে ঐ দিন সীনে সূর্য্যকে দেখা যায় আকাশের সুবিন্দুতে আর আলেকজান্দ্রিয়ার আকাশে সূর্য্যকে দেখা যায় সুবিন্দু থেকে ৭.২° দক্ষিণে। ছবিতে দেখুন যে, মধ্যাহ্ন সূর্য্যের এই অবনমনই (যা সহজেই মাপা যায়, তবে তার পদ্ধতিটা এখন বলার অবকাশ নাই) আলেকজান্দ্রিয়া ও সীনের দুই কূয়ার ভিতরের কোণ, যা ইরাটোস্থেনিস মেপেছিলেন। তারপরের প্রশ্ন: ইরাটোস্থেনিস আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সীনের দূরত্বটা কী ক'রে মাপলেন? উত্তরে বলি যে, সেজন্য উনি একটা লোক ভাড়া করেছিলেন। সেই লোকটা একটা উটের পিঠে মরুভূমি (মিশর মরুভূমির দেশ) পেরিয়ে চলে গেল আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সীন। তাতে ক'দিন লাগল, একটা উট দিনে কতক্ষণ চলে আর কতক্ষণ বিশ্রাম নেয়, উটের গতিবেগ কত — এইসব তথ্য থেকে সহজেই বেরিয়ে যায় আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সীনের দূরত্ব।

ইরাটোস্থেনিস যে পদ্ধতিতে পৃথিবীর পরিধি মেপেছেন তা বেশ সুন্দর! তাঁর পরিমাপে কিছুটা ভুল হয়েছিল (আমি আধুনিক মানগুলি দিয়েছি), কিন্তু আজকের দিনে এই পদ্ধতিতে অনায়াসে পৃথিবীর পরিধির মান সূক্ষ্মভাবে নির্ণয় করা যায়। তাঁর পদ্ধতিটা একদম ঠিক, এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। এখন আপনারা এই বিষয়টি নিয়ে আরো আলোচনা করলে অনেকে উপকৃত হবেন। ধন্যবাদ।

কাগজের দূরবীণ | শুভাশীষ চিরকল্যাণ পাত্র

শুভাশীষ চিরকল্যাণ পাত্রের তৈরি কাগজের দূরবীণ


সম্প্রতি বাড়ীর কিছু বাতিল দ্রব্য থেকে আমি একটি ছোটো দূরবীণ তৈরী করেছি। সঙ্গে তার ছবি দিলাম। এই দূরবীণের নলটার অনেকটাই কাগজের তৈরী, তাই একে কাগজের দূরবীণ বলছি। এখন এই দূরবীণ নিয়ে কিছু কথা বলি।

বাড়ীতে একটা বহু দিনের পুরাণো ও খারাপ হয়ে যাওয়া ১৫x৫০ প্রিজম বাইনোকুলার ছিল। তার চারটা প্রিজমের একটা ভাঙা, তাছাড়া তাতে একটা জিনিষকে দু'টা দেখাত। এর ফলে সেটাকে বিশেষ ব্যবহার করা যেত না। সেই বাইনোকুলারের একটা অভিলক্ষ্য (যা একটি উত্তল লেন্স মাত্র), বাড়ীতে থাকা একটা পুরাণো অণুবীক্ষণের অভিনেত্র (মাইক্রোস্কোপের আইপিস) আর কিছুটা কাগজের নল দিয়ে আমি বর্ত্তমান ক্ষুদ্র দূরবীণটি তৈরী করেছি। এই দূরবীণের কাগজের নলটার এক দিকে আছে উত্তল লেন্সটা (যা  এর অভিলক্ষ্য), অন্যদিকে (সরু দিকটায়) আছে অভিনেত্রটা। ব্যাস! আর কিছু এতে নাই। নলটার দৈর্ঘ্য ঐ লেন্সের (অভিলক্ষ্যের) ফোকাস দূরত্বের সমান। কাছের ও দূরের বস্তু দেখার জন্য অভিনেত্রটাকে কাগজের নলের ভিতর দিয়ে সামনে-পিছনে সরিয়ে বস্তুটিকে ফোকাস করা যায়। এই কাজে সুবিধার জন্য একটা জলের বোতলের মুখের অংশটা কেটে নলের সরু প্রান্তটার ভিতরে লাগিয়ে দিয়েছে (সূতা দিয়ে খুব শক্ত করে বাঁধা আছে)। অভিনেত্রটা তার ভিতর দিয়ে স্বচ্ছন্দে যাতায়াত (sliding) করতে পারে। সবকিছু আটকাতে সূতা, টেপ, লিউকোপ্লাস্টার ইত্যাদি ব্যবহার করেছি। সবকটি দ্রব্যই বাড়ীতে ছিল, তাই এই দূরবীণ বানাতে আমার এক পয়সাও খরচ হয়নি।

এই দূরবীণে চাঁদের পাহাড়, বৃহস্পতির চারটি বৃহৎ উপগ্রহ, অ্যাণ্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি, শুক্রের কলা (সরু কাস্তের মতো দশাটা), তারাপুঞ্জ (Star clusters) ইত্যাদি দেখা সম্ভব। কৃত্তিকা, মৌচাক ইত্যাদি পুঞ্জগুলিকে এতে নয়নাভিরাম লাগে...

এই দূরবীণে চাঁদের পাহাড়, বৃহস্পতির চারটি বৃহৎ উপগ্রহ, অ্যাণ্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি, শুক্রের কলা (সরু কাস্তের মতো দশাটা), তারাপুঞ্জ (Star clusters) ইত্যাদি দেখা সম্ভব। কৃত্তিকা, মৌচাক ইত্যাদি পুঞ্জগুলিকে এতে নয়নাভিরাম লাগে। অবশ্য শনির বলয়টা এতে দেখা সম্ভব নয়। এটাকে একটা ষ্ট্যাণ্ডে লাগাতে পারলে আকাশ দেখার আরো সুবিধা হতে পারে, কিন্তু সে ব্যবস্থা আমি করে উঠতে পারিনি।

প্রসঙ্গত, গ্যালিলিওর তৈরী দূরবীণ (যা দিয়ে তিনি আকাশপর্যবেক্ষণে  যুগান্তর এনেছিলেন) এর চেয়ে খুব একটা বেশী শক্তিশালী ছিল না। আমি যেখানে অভিনেত্র (আইপিস) হিসাবে একটা মাইক্রোস্কোপের অভিনেত্র ব্যবহার করেছি, গ্যালিলিও সেখানে অভিনেত্র হিসাবে একটা ছোটো অবতল লেন্স মাত্র ব্যবহার করেছিলেন। তার ফলে তাঁর দূরবীণে প্রতিবিম্ব সোজা দেখাত। সেই তুলনায় আমার এই দূরবীণে প্রতিবিম্ব উল্টা (inverted) দেখায়। তবে আকাশ দেখার সময় তাতে কোনো অসুবিধা হয় না।

আপনাদের কারো বাড়ীতে একটি ভাল মানের উত্তল লেন্স  থাকলে তিনি এমন একটি দূরবীণ বানানোর চেষ্টা করতে পারেন। অভিনেত্র কলকাতার কলেজ ষ্ট্রীট থেকে কিনে নিতে পারেন।
  • ওপার বাংলার লেখকঃ শুভাশীষ চিরকল্যাণ পাত্র



স্যাটেলাইট কী, কেন, কিভাবে, কোথায়? কী লাভ?

জিওস্টেশনারি ও পোলার স্যাটেলাইটের অরবিট

স্যাটেলাইট শব্দটা জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন জোহানেস কেপলার, ১৬১০ সালে, বৃহস্পতিকে ঘিরে ঘূর্ণায়মান চাঁদগুলোকে বুঝানোর জন্য, যে চাঁদগুলো প্রথম দেখেছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি, তার নিজের নির্মিত টেলিস্কোপ দিয়ে।
মনে প্রশ্ন আসছে না, স্যাটেলাইটের নাম কেন “স্যাটেলাইট”? উত্তরটা দেয়া যাক। স্যাটেলাইট শব্দটা আসছে ল্যাটিন থেকে, যেটার ইংরেজি অনুবাদ করলে দাঁড়ায় “অনুসরণ করা”। চাঁদ পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে, চাঁদ একটি স্যাটেলাইট। পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে, সুতরাং পৃথিবীও একটি স্যাটেলাইট। সূর্য আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সিকে ঘিরে ঘুরছে, সুতরাং সূর্যও একটি স্যাটেলাইট। এগুলা হচ্ছে প্রাকৃতিক স্যাটেলাইট। কিন্তু, “মানুষের তৈরি কোনো যন্ত্র পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে” এই ধরণের কিছু বুঝানোর জন্য “স্যাটেলাইট” শব্দটার ব্যবহার হয় প্রথমে থিওরিটিক্যালি, ১৯৩৬ সালে এবং পরে বৈজ্ঞানিকভাবে গৃহীত হয় ১৯৫৭ সালে, যখন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠায়। স্পুটনিক-১ এর নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। এর পরের বছরই ১৯৫৮ সালে আমেরিকা পাঠায় তাদের বানানো প্রথম স্যাটেলাইট, নাম এক্সপ্লোরার-১।

স্যাটেলাইট জিনিসটা আসলে কী?

জিনিসটা আসলে কী? একটা জিনিস রকেট দিয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে পাঠিয়ে দিলাম, কেন সেটা ছিটকে পড়ছে না বাইরে? বা, আবার পড়ে যাচ্ছে না পৃথিবীতে? এখানেই বিজ্ঞানের সৌন্দর্য। যে কোনো বস্তুই অন্য বস্তুকে নিজের দিকে টানে, যাকে আমরা মহাকর্ষ বলি। আর, সেই বস্তুগুলার একটা যদি পৃথিবী হয়, তখন পৃথিবী যেই বলে অন্য বস্তুটাকে টানে, তাকে বলে অভিকর্ষ (অর্থাৎ, অভিকর্ষ মহাকর্ষের একটি বিশেষ নাম, যেখানে পৃথিবী অন্তর্ভুক্ত)। এই মহাকর্ষ বলের কারণেই আমরা এবং সৌরজগতের অন্যরা সূর্যের চারিদিকে ঘুরছি অবিরাম। তো, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে কোনো স্থানে (কক্ষপথে) পৃথিবীর এই আকর্ষণবল এবং পাঠানো বস্তুর গতি, এই দুটোর ভারসাম্য খুঁজে বের করে যদি সেই গতিতে কোন কিছুকে সেখানে পাঠানো হয়, তখন সেটা সেখানে পৃথিবীর আকর্ষণে আটকে গিয়ে ঘুরতে থাকবে পৃথিবীকে ঘিরে। যেহেতু বায়ু বা অন্য কোনো কিছুর বাধা নেই সেখানে, তাই সেই গতিতেই সেটা চলতে থাকে, চলতেই থাকে (নিউটনের গতির প্রথম সূত্র)।
বুঝলাম যে, তারা পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সেখানে তো হাজার হাজার এরকম স্যাটেলাইট ঘুরছে। কিন্তু, তাদের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ হচ্ছে না কেন? সংঘর্ষ হচ্ছে না কারণ তারা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন কক্ষপথে এবং ভিন্ন ভিন্ন গতিতে প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবীকে। এরপরও যে সংঘর্ষ হয় না, তা না। এইতো ২০০৯ এর ফেব্রুয়ারিতেই দুইটা কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট এর মধ্যে সংঘর্ষ হলো যারা একটি ছিল আমেরিকার, আরেকটি রাশিয়ার। তবে এটিই এখন পর্যন্ত এই ধরনের একমাত্র ঘটনা।

কেন?

হাজার ট্যাকা খরচ করে পাঠায়ে তো দিলাম। লাভ কী? লাভ হইলো, এইযে আপনি ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফেসবুকে বসে স্যাটেলাইটের প্রয়োজন নিয়ে মজা করছেন, ট্রল করছেন, সেই আপনি যেন আপনার জীবনটা একটু স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে কাটাতে পারেন সেটা নিশ্চিত করা। সেটা কিভাবে করে? সেটা করে আবহাওয়া সম্পর্কে আগাম পূর্বাভাস দিয়ে, যাতে আপনি আপনার প্র্যাতাহিক জীবনে আবহাওয়া, ঝড় ,জলোচ্ছ্বাস, হ্যারিকেন এসব সম্পর্কিত ঝামেলায় কম পড়েন। এরপর ধরেন, অব্যবহৃত ব্রেইনের অকার্যকারিতার কারণে কখনো কোথাও হারিয়ে গেলে যেন নিজের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে অন্যদেরকে নিখুঁত তথ্য দিতে পারেন সেটা নিশ্চিত করা। যেন ফোনে আপনার বন্ধুর সাথে স্যাটেলাইটের অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে, এটা বানাতে এবং পাঠাতে যে হাজার কোটি টাকার অপচয়, সেটা নিয়ে আরও সহজে এবং ঝামেলামুক্তভাবে ঠাট্টা মশকরা করতে পারেন, সেটার ব্যবস্থা করা। ঠাট্টা মশকরা করা শেষ হলে এরপর একটা টিভি চ্যানেল খুলে যেন আরামসে কিছুক্ষণ কোনো ঝামেলা ছাড়া কোয়ালিটি টাইম পাস করতে পারেন, সেটার ব্যবস্থা করা। আপনার জন্য আপাতত এগুলোই। আরও অনেক কিছুই আছে যেগুলা আসলে আপনার দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় বলে মনে না হওয়াই স্বাভাবিক। যেমন, সূর্য, সৌরঝড়, উল্কাপাত, উল্কাদের গতি-প্রকৃতি এবং সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলো পর্যেবক্ষণ করা। সৌরজগতের বাইরের নক্ষত্র, গ্রহ, গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করা যেসব বিজ্ঞানীদেরকে আমাদের এই মহাজগৎ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে সাহায্য করবে।

কত প্রকার?

অনেক ধরণের স্যাটেলাইটই আছে। তবে, মূলত যে দুটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত সেদুটি হচ্ছে জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট এবং পোলার অরবিটিং স্যাটেলাইট। জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট হচ্ছে সেগুলো যেগুলোর গতি পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির সমান এবং বিষুবরেখা বরাবর পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘুরতে থাকে। ফলে তাদেরকে পৃথিবী থেকে একটা নির্দিষ্ট অবস্থানের সাপেক্ষে স্থির বলে মনে হয়, যেটা এইরূপ নামকরণের কারণ। মূলত রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন, কোন কিছুর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য (GPS – Global Positioning System) – এই ধরণের যোগাযোগের কাজে ব্যবহৃত হয় এই স্যাটেলাইট।
আরেকটি হচ্ছে পোলার অরবিটিং স্যাটেলাইট। নাম থেকেই বুঝা যাচ্ছে, এটার ঘূর্ণনগতি হচ্ছে পোল টু পোল, মানে উত্তর দক্ষিণ বরাবর। যেহেতু পৃথিবী ঘুরে পূর্ব পশ্চিম বরাবর এবং এই স্যাটেলাইট ঘুরে উত্তর দক্ষিণ বরাবর, তাই এটা পৃথিবীর কোনো একটা অবস্থানের সাপেক্ষে কখনোই স্থির থাকে না, বরং একেকবার পৃথিবীর একেক অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রদক্ষিণ করে। এই ধরণের স্যাটেলাইট মূলত ব্যবহার হয় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়া সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য। এটির উচ্চতাও জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট এর তুলনায় অনেক কম। জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের ভূপৃষ্ঠ থেকে দূরত্ব যেখানে প্রায় ২০,০০০ কিলোমিটার, পোলার স্যাটেলাইট এর ক্ষেত্রে এই দূরত্ব মাত্র ৮৫০ কিমি। ফলে এটি আরও অনেক ভালোভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও ভূপৃষ্ঠ স্ক্যান করতে পারে এবং আবহাওয়া সম্পর্কে তথ্য দিতে পারে আরও নিখুঁতভাবে।

বাংলাদেশের জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট, যা প্রথমে মে ১০, ২০১৮ তারিখে লঞ্চ করার কথা ছিল, যেটা কারিগরি সমস্যার কারণে সম্ভব হয়নি; যে কোনো স্যাটেলাইট পাঠানোর ক্ষেত্রে যেটা খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার। পরের দিন, অর্থাৎ মে ১১, ২০১৮ তারিখে সফলভাবে স্যাটেলাইটটি মহাশূন্যে প্রেরণ করা হয়।
এটা কি বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট? অনেকেই দেখলাম এই ভুলটা করছে। না, এটা বাংলাদেশের পাঠানো প্রথম স্যাটেলাইট না। বাংলাদেশ থেকে পাঠানো প্রথম স্যাটেলাইট হচ্ছে “ব্র্যাক অন্বেষা”, সেটা একটা পোলার ন্যানো-স্যাটেলাইট যেটা পাঠানো হয়েছে ৩ জুন, ২০১৭ তারিখে। তবে বঙ্গবন্ধু-১ হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম জিওস্টেশনারি কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট। মজার ব্যাপার হচ্ছে, “ব্র্যাক অন্বেষা”এবং বঙ্গবন্ধু-১, দুটোই স্পেস-এক্স নামক সংস্থার মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে।
স্যাটেলাইট দুনিয়ায় আমাদের প্রবেশ আরো আগে হলেও কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইটের জগতে আমরা প্রবেশ করেছি বঙ্গবন্ধু-১ এর মাধ্যমে। এটা কি চমৎকার এবং অসাধারণ অনুভূতির একটা ব্যাপার না যে, নিজের দেশের কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট জগতে পদার্পণের মুহূর্তের সাক্ষী হতে পেরেছি আমরা?