কুড়িগ্রাম নিয়ে আমার অনুভূতি অতঃপর সোনাহাট স্থল বন্দর | কাজী শফিকুর রহমান

কাজী শফিকুর রহমান;
বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)



এটি আমার নিজস্ব চিন্তা ভাবনা, কোন গবেষণালব্ধ প্রতিবেদন নয়। আমার এ অনুভূতির সাথে একমত হতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকথা নেই। কোন ব্যাপারে দ্বিমত থাকলে অনুগ্রহ করে মন্তব্যে লিখবেন। বানান ও ভাষাগত ত্রুটি থাকলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ করছি।

ওকি গাড়িয়াল ভাই
হাকাও গাড়ী তুই চিলমারী বন্দরে।

বিখ্যাত কন্ঠ শিল্পী মরহুম আব্বাস উদ্দিন আহমদ এর ভাওয়াইয়া গানের রেশ টেনে বলতে চাই কুড়িগ্রাম হচ্ছে ভাটির দেশ। ভাটিয়ালি গানের জন্য বিখ্যাত।দেশের একপ্রান্তে কুড়িগ্রাম জেলা। এ জেলা ০৯টি উপজেলা নিয়ে গঠিত।  এক সময় মঙ্গাপীড়িত দরিদ্র জেলা হিসবে পরিচিত ছিল। যদিও এখন মঙ্গা অনেকটা দূর তবুও  বাংলাদেশের পরিসংখ্যানে দারিদ্র্যের হার এখনো বেশী।

চিলমারী একসময় নৌ বন্দরের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখন নৌ বন্দর চালু নেই।  চিলমারী কুড়িগ্রাম জেলার একটি উপজেলা। দাদুবাড়ি এবং নানুবাড়ি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে তখনকার বন্দর এবং তাকে ঘিরে বিভিন্ন কর্মচাঞ্চল্যের কথা শুনেছি। বড় বড় জাহাজ আসতো আবার বড়ো বড়ো নৌকায় পাট এবং অনান্য কৃষিজাত পণ্য বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এমন কি ভারতে রপ্তানি করা হতো। বয়সে তখন অনেক ছোট, এখন আধো আধো মনে  আছে, জাহাজ এসেছে বলে মামারা তা দেখাতে নিয়ে গেলেন। ফেরার সময় হাট থেকে পায়ের এক জোড়া মোজাও কিনে দিয়েছিল। অনেক ভীড় ছিল এতটুকু মনে অাছে। এখন মনে হয়,  অনেক কর্মসংস্থান তখন তৈরি হয়েছিল। ব্রম্রপূত্র নদের ভাঙ্গনে দাদুবাড়ি নানুবাড়ি তা গ্রাস করায়  খুব একটা সেখানে যাওয়া হয় না। দেশ স্বাধীন হবার  পূর্বে নদীবন্দর স্থগিত হওয়ায় সেখানে কর্মচাঞ্চল্য অনেকটা স্থবির হয় যার ঢেউ এসে সবচেয়ে আঘাত হানে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময়।

এক সময় রেল ছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কোথাও যাতায়াতের সুযোগ ছিল না। তাও ছিল মাত্র দুটো।  পরে তিনটা। বর্তমানে একটি বা দুটি। জেলা থেকে সামান্য দূরে রাজারহাট উপজেলা। সেখানে স্বল্প জমি থাকায় বাবা  প্রায়শঃ যেতেন।  দুপুরে ট্রেনে উঠলে রাত্রের ট্রেনে ১১ টায় ফিরতেন। আমাদের অনেক সহপাঠী সেখান থেকে ট্রেনে ক্লাস করতেন।১৯৮০ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তিস্তা রেল সেতুতে সড়ক পরিবহনে ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ জেলার যোগাযোগে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিলেন। তখন থেকে সড়ক পরিবহন মানুষের নিকট আকৃষ্ট হলো এবং আস্তে আস্তে রেল পথ অবহেলার শিকার হলো। আজ কোন কারণে সড়কে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে কুড়িগ্রাম সারাদেশের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর একটি অঞ্চলের জনগণের ভাগ্যেরও পরিবর্তন হয়। যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম থাকা উচিত। একটির প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে বিকল্প ব্যবস্থায় প্রয়োজন মিটানো যায়। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দেশের বিভিন্ন জেলার সাথে আন্তঃ নগর ট্রেনের ব্যবস্থা করে যোগাযোগ ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেন। পরবর্তী সরকার প্রধানগন এ কার্যক্রম তরান্নিত করলেও এখন পর্যন্ত এ জেলা সে সুযোগ পায়নি। এ প্রজন্মের একঝাঁক তরুণ  আন্তঃনগর ট্রেনের দাবীতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সে সংগে নৌ পথ চালুর দাবীতে ঐক্যবদ্ধ। আমি তাঁদের দাবীর সাথে নৈতিকভাবে সহমত পোষণ করি।

 উত্তর ধরলা বলে খ্যাত সদর উপজেলার কতিপয় ইউনিয়ন, নাগেশ্বরী,ফুলবাড়ী এবং ভূরাঙ্গামারী অনেক অনেক বছর ধরলা নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন ছিল। ১৯৯৬ সালের পর তৎকালিন মাননীয় প্রধান মন্ত্রী ( বর্তমানেও) শেখ হাসিনা ধরলা নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তরের উদ্বোধন করেন। সে আমলেই ব্রিজের কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে বাকী কাজগুলো সুসম্পন্ন করতঃ প্রাক্তন মাননীয় প্রধান মন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এসে তা উদ্বোধন করেন। বেড়ে যায় মানুষের কর্মচাঞ্চল্য। এখনো কুড়িগ্রামের দুটি উপজেলা রৌমারী এবং রাজিবপুর নদী দ্বারা অনেকটা জেলার সাথে বিচ্ছিন্ন।

এ জেলার মানুষ কাজ চায়। তাঁদের যে কোন কাজ করার আগ্রহ আছে। আজ ( ২৫ জানুয়ারি) ভুরাঙ্গামারী উপজেলায় একবারে প্রান্তিক গ্রামে মেঠোপথ ধরে বাইকে স্ত্রীসহ ঘুরলাম। উদ্দেশ্য আমার দাদা শ্বশুরের পুরাতন বাড়ি দেখা। এক সময় গ্রাম অঞ্চলে ছন বা খরের তৈরি বাড়িগুলো উধাও হয়ে সেখানে ঠাঁই নিয়েছে টিনের তৈরি ঘর বাড়ি। মাঝেমধ্যে ইটের তৈরি হাফ বিল্ডিং। শুনলাম এ জেলার শ্রমজীবী মানুষ বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অট্টালিকা ও  রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তাদের কষ্টার্জিত শ্রম যেমন দেশের উন্নয়নে অবদান রেখেছে তেমনি পারিবারিক উন্নয়ন এবং জেলার উন্নয়নে সমানতালে অবদান রেখে চলেছে। অনার্স মাস্টার্স কোর্স কুড়িগ্রামে চালু হওয়ায় শিক্ষার্থীবৃন্দের সাথে মেশার সুযোগ হচ্ছে। তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারি তারা যে কোন কাজ করার জন্য প্রস্তুত।  বর্তমানে অনেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রাইভেট টিউশানি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে নিজের লেখাপড়া খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা নিজেরাই সংস্থান করছেন।

যে মঙ্গার কথা আগে শুনা যেতো, তা অনেকটা দূরীভূত হতে চলেছে। এখন চরবাড়িতে বাদাম ভুট্রা,কাউন, ডাল ইত্যাদি ধরনের কৃষিজাত ফসল উৎপাদন হচ্ছে। তারপরেও বেকার মানুষের সংখ্যা অনেক। এদের ঠিকমতো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিলে এ জেলার দারিদ্র্যের হার অনেক নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব।

যে মঙ্গার কথা আগে শুনা যেতো, তা অনেকটা দূরীভূত হতে চলেছে। এখন চরবাড়িতে বাদাম ভুট্রা,কাউন, ডাল ইত্যাদি ধরনের কৃষিজাত ফসল উৎপাদন হচ্ছে। তারপরেও বেকার মানুষের সংখ্যা অনেক। এদের ঠিকমতো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিলে এ জেলার দারিদ্র্যের হার অনেক নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব।

গত ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ সালে শ্বশুর বাড়ীতে গমন করেছিলাম। উক্ত বাড়িতে খুব একটা যাতায়াত করা হয় না। এর জন্য স্ত্রীর নিকট কম ঝাড়ি খাইনি। পৌছা মাত্র বড় মেয়ের বায়না সোনাহাট স্থল বন্দর দেখবে। এর আগে যখন সেখানে বন্ধুদের সাথে গিয়েছিলাম তখন বন্দর চালু হয়নি। বিকাল ৪ ঘটিকায় পরিবার পরিজন নিয়ে সেখানে পৌঁছিলাম। দেখলাম সেখানে একধরনের প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। কাস্টমস কর্মকর্তার নিকট নিজ পরিচয় দেবার পর জানতে পারলাম পুরাদমে বন্দর চালু হয়নি। ভারত থেকে ১৮ টি পণ্যের মধ্যে মাত্র দুটি পণ্য কয়লা এবং পাথর আমদানী হচ্ছে। এদেশ থেকে  কোন পণ্য সেখানে রপ্তানি হচ্ছে না। এর কারণ আমি নিজে যেটি উপলব্ধি করেছি এবং কথাবার্তা থেকে যেটি অনুমান করেছি সেটি হচ্ছে যাতায়াতের প্রতিবন্ধকতা। সেখানে অনেক C& F (Clearing and Forwarding Agent) এর অফিস ঘরও দেখলাম। আমার জানামতে ভারতের 7 Sisters নামে খ্যাত ৭টি রাজ্যের মধ্যে বর্তমানে সোনাহাটসহ তিনটি বন্দর চালু আছে। বাকিগুলো ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সাথে। উদ্দেশ্য হলো- সোনাহাটের সাথে ভারতের আসাম রাজ্যের সংযোগ সাধন করা। উক্ত বন্দরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ভারত তাদের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রায় প্রস্তুত করেছে। আমাদের এখানে অনেক অবকাঠামোর কাজ বাকি আছে।

কুড়িগ্রামের উন্নয়নে আমার কতিপয় সুপারিশঃ

১। দলমত নির্বিশেষে উন্নয়নের ব্যাপারে সকলকে ঐক্যমত্য হতে হবে।
২। সোনাহাট স্থল বন্দরে যাতায়াত করার জন্য দুধকুমোর নদীর উপর রেলপথসহ সড়ক ব্রিজ নির্মাণে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৩। বর্তমানের ব্রিজটির অত্যন্ত বেহাল অবস্থা হয়েছে। যে কোন সময়ে ভারী যানবাহন চললে তা ভেঙ্গে যেতে পারে। ব্রিজ নির্মাণ যেহেতু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার সেহেতু নদী ড্রেজিং করে ফেরীর ব্যবস্থা চালু করে ভারী যানবাহনের পথ সুগম করা।
৪। সোনাহাট স্থল বন্দরে পণ্য আমদানি রপ্তানির পাশাপাশি ভিসার ব্যবস্থা চালু করা। এতে দু দেশের জনগণ এবং ব্যবসায়ীবৃন্দের মধ্যে আরো নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
৫। প্রস্তাবিত ২য় তিস্তা এবং ধরলা ব্রিজে সড়কের পাশাপাশি রেলপথের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৬। রৌমারী এবং রাজিবপুরের সাথে যোগাযোগের জন্য কুড়িগ্রামের মোল্লাহাট এবং রৌমারী দাঁতভাঙ্গার সাথে যে নদীপথ সংযোগ করার কথা শোনা যাচ্ছে,  তা অবিলম্বে চালু করা। এতে ঢাকা,  সিলেট এবং চট্রগ্রামের সাথে সড়কপথের যেমন বিকল্প ব্যবস্থা চালু হবে ঠিক তেমনি দূরত্বের পরিমাণ ও সময় অনেক হ্রাস পাবে। অদূর ভবিষ্যতে ব্রিজ নির্মাণের ব্যবস্থা করলে তাতে বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী ব্রিজের ক্রমবর্ধমান চাপ অনেক কমবে।
৭। আন্তঃনগর ট্রেন এবং নৌপথ চালু করা।
৮। Out sourcing ব্যাপারে নতুন প্রজন্মের কাজ করার যে আগ্রহ আছে সেখানে তারা যাতে প্রতারিত না হয় সে ব্যাপারে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসা। এ সংক্রান্ত পত্রিকায় প্রকাশিত খবর সুখকর নয়।
৯। তরুণ সমাজকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আবেগকে প্রশ্রয় না দেওয়া। বাস্তব যতই কঠিন হউক না কেন তা মোকাবেলা করা। নিজেদের প্রয়োজনে একে অন্যকে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে জানা জ্ঞান বিতরণেরর ব্যবস্থা করা। উদাহরণস্বরূপ হয়তো একজন ইংরেজিতে একটু দক্ষ কিন্তু অংকে দুর্বল।  আবার আরেকজন এর বিপরীত।

এগুলো ছাড়াও  বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ কুড়িগ্রাম উন্নয়নের যে সুপারিশ প্রদান করেছেন,  সেগুলোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আমার বিশ্বাস  এক সময় দেশের অন্যতম জেলা হিসেবে বিবেচিত হবে। এখানে শ্রম সস্তা, সহজলভ্য কৃষিজাত পণ্য এবং ভারতে আমদানী এবং রপ্তানি পণ্যের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন উদ্যোক্তা এবং শিল্প কলকারখানার মালিক গণ এখানে ব্যবসায় স্থাপনে আগ্রহী হবেন। কর্মচাঞ্চল্যের মাধ্যমে এখনকার তরুণ সমাজের হতাশাও দূর হবে ইনশাল্লাহ।

0 Comments:

Post a Comment