![]() |
জাতীয় দলের ফুটবলার কোহিনূর রহমান |
- পোস্টটির লেখকঃ আব্দুল কাইয়ূম রন্জু
ভারত উপমহাদেশ থেকে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া মূল্যবান হীরকখন্ড কোহিনূর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দখলে গেলেও ৭০ দশকে এসে কোহিনূর নামের এক মুল্যবান মানব সম্পদের দেখা মেলে উত্তরের অবহেলিত জনপদ কুড়িগ্রামের মোল্লা পাড়ায় ।বাবা জনাব আব্দুল খালেক এবং মা বেগম শামসুন নাহারের চতুর্থ পুত্র হয়ে এ পৃথিবীতে আগমন কোহিনূর রহমানের । সেসময় বাবা-চাচারা কুড়িগ্রামের অত্র অঞ্চলে ফুটবল শাসন করতো । তাঁদের দেখানো পথে একজন কোহিনূর রহমানের সৃষ্টি কুড়িগ্রামে ।
তখন ফুটবলের স্বর্ণযুগ । এমনই সময় কোহিনূর একটু একটু আলো ছড়াতে শুরু করলো কুড়িগ্রামের ফুটবলের সূতিকাগার খ্যাত মোল্লাপাড়ায়। বাড়ির সামনে বিস্তর গওহরপার্ক মাঠ । সেই মাঠেই সকাল-বিকেল অনুশীলন। একজন বিখ্যাত ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন চোখে মুখে । মূলত কোহিনুরের ফুটবলে হাতেখড়ি কুড়িগ্রাম পুরাতন শহরের রিভার ভিউ হাই স্কুলে। খুব অল্প বয়স থেকে তাঁর নৈপুণ্যের দ্যুতি ছড়াতে থাকে দেশের ফুটবল অঙ্গনে । ঢাকা ,খুলনা ,রংপুরসহ বিভিন্ন জেলার লীগে ও টুর্নামেন্টে নজর কাড়া পারফর্মেন্স ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে ঢাকা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগের দল সাধারণ বীমায় খেলার সুযোগ করে দেয় । পরের বছর শান্তিনগরের হয়ে আগাখান গোল্ড কাপে অংশগ্রহণ করেন । থাইল্যান্ডের রাজবিথী ক্লাবের বিপক্ষে দ্রুত গতিতে গোল করে কোহিনূর প্রশংসা কুড়ান । ১৯৭৭ খ্রিঃ তিনি ঢাকা প্রথম বিভাগের নামীদল ওয়াপদার হয়ে আগাখান গোল্ড কাপে সুনাম অর্জন করেন । ১৯৭৮ খ্রিঃ ঢাকা প্রথম বিভাগ লীগে ওয়াপদার হয়ে ৮টি গোল করেন । দিলকুশার বিরুদ্ধে একটি ম্যাচে হ্যাট্রিক করেন । ১৯৭৮ খ্রিঃ শেরেবাংলা কাপ জাতীয় ফুটবল টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে টাঙ্গাইলের বিরুদ্ধে জয়সুচক গোল করে রংপুর জেলা দলকে ফাইনালে তুলে নিয়ে আসার পিছনে কোহিনূরের অনবদ্য অবদান আজও অম্লান স্মৃতি হয়ে আছে।
১৯৭৯ খ্রিঃ কুড়িগ্রামের গর্ব কোহিনুব্র রহমান এ দেশের ঐতিহ্যবাহী ফুটবল ক্লাব ঢাকা মোহামেডানের সাদাকালো জার্সি গায়ে জড়ান । ক্ষিপ্ত গতি সম্পন্ন এই রাইট উইঙ্গার সেই মৌসুমে লীগের প্রথম খেলায় ধানমন্ডি ক্লাবের বিরুদ্ধে জয়সুচক গোলটি করেন। ১৯৮২ খ্রিঃ লীগের শেষ খেলায় লীগ চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর বিপক্ষে গোল করেন । সে বছর ঢাকা লীগে মোহামেডানের কৃতি স্টাইকার সালাম মুর্শেদি ২৭টি গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড অর্জন করেন যা অদ্যাবধি কেউ ভাঙ্গতে পারেনি। সালাম মুর্শেদির এই সর্বোচ্চ গোলদাতার পিছনে কোহিনূর অসামান্য অবদান রাখেন। সে মৌসুমে মোহামেডান লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় ।
১৯৮৩খ্রিঃ মারাত্মক ইনজুরিতে পড়ে কোহিনূরের ফুটবল ক্যারিয়ারে ছন্দপতন হয়। নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে ১৯৮৫ খ্রিঃ পর্যন্ত কোহিনূর ঢাকা প্রথম বিভাগ লীগে কখনো ঢাকা ওয়ান্ডারর্স বা অন্য কোন দলের হয়ে খেলেন । ১৯৮৬ শেরেবাংলা কাপ জাতীয় ফুটবল টুর্নামেন্টে কুড়িগ্রাম জেলা দলকে সেমিফাইনালে উঠার পিছনে কোহিনূর বিশেষ ভুমিকা রাখেন। সে বছরই তিনি ফুটবলের জগত থেকে অবসর নিয়ে অ্যামেরিকায় পরিবার পরিজনসহ স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
এ দেশের ফুটবলের ইতিহাসে কোহিনূরের উল্লেখযোগ্য সাফল্যঃ--
ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান দলের সদস্য ১৯৮০,১৯৮১,১৯৮২
লীগ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান ক্লাবের সদস্য ১৯৮০.১৯৮২
বাংলাদেশের প্রথম ক্লাব হিসাবে ঢাকা মোহামেডান ভারতের দুর্গাপুরে আশীষ-
জব্বার স্মৃতি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় তিনি সে দলের সদস্য ছিলেন।
জাতীয় দলের হয়ে সবুজ দলের পক্ষে ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৮১ খ্রিঃ জাতীয় দলের হয়ে পাকিস্তানে কায়েদা আজম ট্রফি খেলেন ।
১৯৮২ দিল্লীতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন ।
সোনালী অতীতে কোহিনূর রহমান ঃ-
সত্তর-আশি দশকে দেশব্যাপী ফুটবলের মাতম । ফুটবল জোয়ারে ভাসছি আমরা। ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের পয়েন্ট টেবিল আমাদের হাতের গনায়। রেডিও টিভিতে চোখ কান পেতে থাকি । দৈনিক বাসি পত্রিকায় খেলার পাতা নিয়ে কাড়াকাড়ি করি । পাক্ষিক ক্রীড়া জগতের খোঁজে এদিক ওদিক চেয়ে থাকি । গোটা দেশ দুটো শিবিরে বিভক্ত । একদিকে ঐতিহ্যের প্রতীক ঢাকা মোহামেডান আর অন্যদিকে আধুনিকতার প্রতীক আবাহনী ক্রীড়া চক্র। এখন যেমন বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকায় ছেয়ে যায় দেশ ঠিক তখন আবাহনী-মোহামেডানের খেলায় সাদা-কাল আকাশী-হলুদ পতাকায় ছেয়ে যায় সারা দেশ । আমি আবাহনীর মেঝভাই জালাল হোসেন লাইজু মোহামেডানের । এক বাড়িতে দুই দলের পতাকা নিয়ে টানাটানি। সেই ফুটবলের ক্রেজে কুড়িগ্রামের একজন কোহিনুর ঢাকা মোহামেডানে খেলছে চোখ মন গর্বে ভোরে যায় ।কখন যে সমর্থন দূর্বার ছুটে চলা কোহিনূর ভাইয়ের পায়ের কারুকাজে মিশে যায় বুঝাই যায় না । ভিতর থেকে মনটা বলে উঠে আবাহনী জিতুক তবে কোহিনূরভাই গোল দিক।
কোহিনূর পাগল আমার মেঝভাই তার পুরো রুমটা কোহিনূরভাইয়ের ছবির পেপার কাটিংএ ভেসে দিয়েছে। রুমের দেওয়ালে চোখ পাততেই ১১ নম্বর জার্সির ছড়াছড়ি । তখন ঢাকা মোহামেডানে ১১ নম্বর জার্সিতে রাইট উইঙ্গার হিসেবে কোহিনুরভাই আর ১২ নম্বর জার্সিতে লেফট উইঙ্গার হিসেবে গাফফার বল নিয়ে ছুটে চলায় স্টাইকার সালাম গোলের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। কোহিনূর ভাইয়ের পায়ে বল আর পূর্ব গ্যালারী থেকে হটপেটিস হটপেটিস বলে ভক্তদের আমুদেয় চিৎকার । আমরা অপেক্ষায় থাকি লীগ শেষে কবে কোহিনূরভাই কুড়িগ্রামে ফিরবে। আমাদের আইডল তখন কোহিনূরভাই। হবেই না বা কেন ? রোগ,শোক,অভাব অনটনের কুড়িগ্রামের তখন অহংকার করে বলার মত আর কি বা আছে !
ক্রিকেটের সুদিনে ফুটবল ক্রেজ এখন অতীত । তবুও সার্বিক চেষ্টা চলছে ফুটবলের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার । পুরো দেশের মত কুড়িগ্রামেও চলছে বিভিন্ন কর্নার থেকে ফুটবলের উন্নয়নের নানাবিধ প্রচেষ্টা । ফুটবল হউক কুড়িগ্রামের নগরী এই আহবানে সাড়া দিয়ে সুদূর অ্যামেরিকা থেকে কোহিনূরভাই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন । এখন প্রতিনিয়ত তার মনটা এখানেই পড়ে থাকে।
ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়াতে,এদেশের ফুটবলকে বিশ্বমানে পৌঁছাতে প্রয়োজন দ্রুত ফুটবল কাঠামোকে ঢেলে সাজানো ,সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন খাতে পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো সর্বোপরি কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে ফুটবল প্রেম হৃদয়ে ধারণ তবেই হয়তো একাধিক কোহিনূরের পায়ের আওয়াজ শুনতে পাবে কুড়িগ্রাম তথা গোটা বাংলাদেশ ।
-----
পুনশ্চঃ
লেখা এবং ছবি লেখকের fb ID থেকে সংগৃহীত।
আমাদের অহংকার, আমাদের গৌরব।
ReplyDelete