সূর্য্য ও চাঁদের দূরত্ব ও আকার এবং সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্ব বিষয়ে সামোসের অ্যারিস্টার্কাসের গবেষণা
খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে সামোসের অ্যারিস্টার্কাস (৩১০-২৩০ খ্রীঃপূঃ) অর্ধচন্দ্র ও সূর্য্যের কৌণিক দূরত্বের পরিমাপ করে এবং চন্দ্রগ্রহণের স্থায়িত্ব থেকে পৃথিবী থেকে সূর্য্য ও চাঁদের দূরত্বের অনুপাত এবং এই তিনি জ্যোতিষ্কের ব্যাসের অনুপাত নির্ণয় করেন। তাঁর পদ্ধতিটা খুবই সহজ। তবে তাঁর পরিমাপে কিছুটা ভুল হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন সূর্য্য চাঁদের ১৯ গুণ দূরে আর তার ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ৬.৭ গুণ। আজকের দিনে আমরা জানি যে সূর্য্য চাঁদের চেয়ে প্রায় ৪০০ গুণ দূরে আর তার ব্যাস পৃথিবীর প্রায় ১১০গুণ (চাঁদের ব্য়াসের প্রায় ৪০০ গুণ)। পরিমাপে ভুল করলেও সূর্য যে পৃথিবীর চেয়ে অনেক গুণ বড়, তা তিনি প্রমাণ করেছিলেন। তাঁর গবেষণার ফলাফল ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বে তাঁর অনাস্থা এনে দেয়। সূর্য এত বড়, পৃথিবী এত ছোট — তাহলে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরবে কী ক'রে? তাঁর সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হল একটা বড় বস্তুর চারদিকেই একটা ছোটো বস্তুর ঘোরা উচিত। তখন তিনি বললেন যে আকাশের বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনির মতো পৃথিবীও একটি গ্রহ আর সব গ্রহই আসলে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। এছাড়া পৃথিবীর নিজ অক্ষে আবর্তনের কথাও তিনি বলেছিলেন। কোপার্নিকাসের বহু (প্রায় ১৮০০ বছর) আগে সৌরজগতের সম্পূর্ণ তত্ত্বটাই তিনি উপস্থাপন করেছিলেন। তবে প্রাচীনকালের মানুষ তাঁর কথা মানেনি।
অ্য়ারিস্টার্কাস কী করে সূর্য্য ও তাঁদের দূরত্বের অনুপাত বের করেছিলেন তা বুঝতে গেলে সঙ্গের ছবি দেখুন। অর্ধচন্দ্র সূর্যের সঙ্গে নিঁখুত সমকোণ করে না, কোণটার মান ৯০° অপেক্ষা কিছু কম। কতটা কম? সেটাই আপনাকে মেপে দেখতে হবে। তাহলেই বের করতে পারবেন সূর্য চাঁদের কতগুণ দূরে। ছবিতে চাঁদের CD ব্যাসটা বাড়িয়ে দিলে পৃথিবীতে পৌঁছাচ্ছে। AB ব্যাসটা তার সমকোণে, সেটা বাড়িয়ে দিলে সূর্যে পৌঁছায়। আপনি পৃথিবী থকে চাঁদের ADB অর্ধাংশকে দেখতে পাবেন। সেটা একটা অর্ধ গোলক। সূর্যের আলো পড়ছে চাঁদের CBD অর্ধ গোলকে। পৃথিবী থেকে আপনি যে ADB অংশ দেখছেন তার শুধু ODB অংশ আলোকিত। AOD অংশে আলো পড়ছে না। ফলে আপনি যতটা দেখছেন তার পূর্বের অর্ধাংশ AOD কালো আর পশ্চিমের অর্ধাংশ BOD আলোকিত। এজন্য আপনি দেখবেন আধখানা চাঁদ। ঐ অর্ধেন্দু কিন্তু আসলে চাঁদের গোলকের এক-চতুর্থাংশ। অতদূরে দৃষ্টির গভীরতা কাজ করে না বলেই অমন (অর্ধবৃত্তাকার চাকতির মতো) দেখায়। ছবিতে চাঁদের কলা ½ (অর্ধচন্দ্র) বলে AB ও CD পরস্পর লম্ব। AB সূর্যে পৌঁছায়, CD পৃথিবীতে। D বিন্দু ADB চাপটির মধ্য বিন্দু হবে। তাই ∠EOS=৯০°। অতএব ∠AES-এর মান ৯০° অপেক্ষা কম হবে। কারণ ত্রিভুজের তিনটি কোণের সমষ্টি ১৮০°। সূর্যের দূরত্ব অসীম নয় বলে ∠ESO-র মান শূন্য হতে পারে না। পৃথিবী থেকে সূর্যকে দেখি ES রেখায়, চাঁদকে EO রেখায়। সূর্য ও চাঁদের কৌণিক ব্যবধান তাই ∠OES, এই কোণটা ৯০° অপেক্ষা কম। পর্যবেক্ষণে পাওয়া যায় ∠OES-এর মান প্রায় ৮৯পূর্ণ৬/৭°। আমাদের চাই সূর্য ও চাঁদের দূরত্বের অনুপাত, অর্থাৎ ES/EO । কী ক'রে সেটা পাব? খুব সহজ: △EOS আঁকুন যাতে ∠SOE=৯০°, ∠SEO= ৮৯পূর্ণ৬/৭° (প্রায়) এবং∠ESO= ⅐°(প্রায়) হয়। ES এবং EO-এর দৈর্ঘ্য স্কেল দিয়ে মেপে নিয়ে ভাগ ক'রে ফেলুন, তাহলেই হল। ত্রিভুজটা বড় আঁকুন, ছোটো আঁকুন তাতে কোন অসুবিধা নেই; যদি কোণগুলি একই থাকে তবে ES/EO-এর মান সর্বদা একই পাবেন। এর কারণ সদৃশকোণী ত্রিভুজের অনুরূপ বাহুগুলি সমানুপাতিক। অবশ্য আপনাকে বডে়া করেই ত্রিভুজটা আঁকতে হবে। তাছাড়া ⅐° কোণ আঁকা সহজ নয়। ES/EO হচ্ছে ∠ESO (=⅐°)–এর সাপেক্ষে অতিভুজ ও লম্বের অনুপাত। ত্রিকোণমিতিতে একে বলে cosec ⅐°। ত্রিকোণমিতির তালিকা থেকে পাওয়া যায় cosec⅐°=৪০০ (চার শত, প্রায়)। অর্থাৎ সূর্য চাঁদের ৪০০ (চার শত) গুণ দূরে। ত্রিকোণমিতি জানলে আপনাকে বিরাট ত্রিভুজ অঙ্কন ক'রে মাপজোক করতে হবে না। ত্রিকোণমিতিক তালিকা দেখেই উত্তরটা পেয়ে যাবেন।
অর্ধচন্দ্র যে সূর্যের সঙ্গে 89⁶/₇° (৮৯পূর্ণ৬/৭°)কোণ ক'রে থাকে (পৃথিবীতে বা আপনার চোখে) সেটা মাপবেন কী ক'রে? মাপা যায়, তার অনেক উপায় আছে। প্রাচীনকালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নিজের হাতে কোণ মাপার যন্ত্র তৈরী করতেন। আজকাল অনেক ভাল ভাল সেক্সট্যাণ্ট যন্ত্র পাওয়া যায়। অ্যারিস্টার্কাস যে কী কায়দায় ঐকোণটা মেপেছিলেন তা আমার জানা নেই। আর একটা অসুবিধা আছে। চাঁদ যে কখন আধখানা হল তা বুঝবেন কী ক'রে? আলো-আঁধারের সংযোগস্থল ঠিক কখন সরলরেখা হল, খালি চোখে তার সঠিক সময়টা বোঝা কষ্টকর। দূরবীণে আরো সহজে বোঝা যায়। অ্যারিস্টার্কাসের ভুলটা এখানেই হয়েছিল। তিনি সূর্য ও অর্ধচন্দে্রর মধ্যবর্তী কোণটা ৮৯পূর্ণ৬/৭°-এর বদলে পেয়েছিলেন ৮৭°। তাই তিনি বলেছিলেন সূর্য চাঁদের ১৯ গুণ দূরে (আসলে ৪০০গুণ হবে)।
সূর্য ও চাঁদের দূরত্বের অনুপাত ৪০০ বলে তো জানলাম, তাদের ব্যাসের অনুপাত কত? খুব সহজ, সূর্যের ব্যাসও চাঁদের ব্যাসের ৪০০ গুণ। কারণ আকাশে চাঁদ ও সূর্য উভয়ের চাকতিই সমান মাপের দেখায়। সূর্যের ব্যাস চাঁদের ৪০০ গুণ এবং দূরত্বও ৪০০ গুণ, তাই সূর্যকে চাঁদের সমান দেখায় (প্রায়)। চাঁদ ও সূর্যের চাকতি যে প্রায় সমান আকারেরই দেখায় তা বুঝবেন কী ক'রে? ভেবে দেখুন, চাঁদের চাকতি সূর্যের চাকতির চেয়ে ছোটো হলে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় তা পুরো সূর্যকে অল্প সময়ের জন্য (বড়জোর কয়েক মিনিট) ঢেকে দেয় কী ক'রে? মাঝে মাঝে আবার বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়, তখন গ্রহণগ্রস্ত সূর্যের একেবারে কিনারার দিকে আলো থাকে। তখন চাঁদের চাকতি সূর্যের চাকতির চেয়ে একটুখানি ছোটো থাকে বলে চঁাদ সূর্যকে সম্পূর্ণ ঢাকতে পারে না, কিনারায় বলয়ের মতো একটু সরু আলোকিত ফালি থেকে যায়। পৃথিবী থেকে সূর্য বা চাঁদ কারও দূরত্বই সর্বদা সমান থাকে না। তাই তাদের চাকতিগুলির ব্যাস সর্বদা সমান দেখায় না। কিন্তু পৃথিবী থেকে তাদের আপাত আকারটা গড়ে আমরা প্রায় সমান সমানই দেখি। মাপজোক ক'রেও এটা প্রমাণ করা যায়। চাঁদের চাকতির একটি ব্যাসের দু'টি প্রান্ত থেকে আপনার চোখ পর্যন্ত দু'টি রেখা টানলে তারা প্রায় ½° কোণ তৈরী করে। একে বলে চাঁদের কৌণিক ব্যাস। সূর্যের কৌণিক ব্যাসও ½° (প্রায়)।
এখন প্রশ্ন: অ্যারিস্টার্কাস কী করে সূর্য্য, চাঁদ ও পৃথিবীর ব্যাসের অনুপাত মাপলেন? চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়ে। সেই ছায়ার ব্যাস মেপে আমরা সূর্য ও পৃথিবীর ব্যাসের অনুপাত জানতে পারি, কারণ পৃথিবী থেকে সূর্য ও চাঁদের দূরত্বের অনুপাতটা আমাদের জানা।পৃথিবীর ছায়াটা শঙ্কুর মতো সরু হয়ে মিলিয়ে যায়, তার কারণ সূর্য পৃথিবীর চেয়ে বড়। তা না হলে ছায়াটা ক্রমাগত সরু হওয়ার পরিবর্তে উল্টানো শঙ্কুর মতো মোটা হতে থাকত। তাহলে পৃথিবী নয়, সূর্যই বড়। কতগুণ বড়? সেটা বের করতে গেলে চাঁদের দূরত্বে পৃথিবীর ছায়া চাকতির কৌণিক ব্যাস জানতে হবে। চন্দ্রগ্রহণের স্থায়িত্ব থেকে সেটা জানা যেতে পারে।
চাঁদর কৌণিক ব্যাস ½°। চাঁদর দূরত্বে পৃথিবীর ছায়ার কৌণিক ব্যাস, ধরুন, x°। ছায়াটা আর চাঁদ যদি পরস্পরক মাঝ বরাবর অতিক্রম করে তবেই গ্রহণের স্থায়িত্ব সবচেয়ে বেশী হবে। আমরা আকাশে সূর্য্যকে (ও তার উল্টাদিকে পৃথিবীর ছায়াকেও) ঘণ্টায় ১৫° এবং চাঁদকে ঘণ্টায় ১৪.৫° করে ঘুরতে দেখি। তাহলে চাঁদের দিকে পৃথিবীর ছায়াটা ঘণ্টায় (১৫°-১৪.৫°) বা ½° ক'রে এগোয়। যদি পৃথিবীর ছায়া এবং চন্দ্রবিম্ব কেন্দ্র বরাবর পরস্পরকে অতিক্রম করে তাহলে পৃথিবীর ছায়াকে নিজের ও চাঁদের ব্যাসের যোগফলের সমান (½°+x°) পথ অতিক্রম করতে হবে। পৃথিবীর ছায়া চাঁদের দিকে প্রতি ঘণ্টায় ½° এগিয়ে যায়। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে চন্দ্রগ্রহণ সর্বোচ্চ পৌনে চার ঘণ্টা (৩.৭৫ ঘণ্টা) পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তার অর্থ ছায়াটা মোট ½°x৩.৭৫ বা, ১.৮৭৫° যায়। এর থেকে চাঁদের চাকতির ব্যাস ½° বাদ দিলে বাকী (১.৮৭৫-½°) বা ১.৩৭৫° হল পৃথিবীর ছায়ার ব্যাস। এই ব্যাস চাঁদের ব্যাসের ১.৩৭৫/½ বা ২.৭ গুণ (প্রায়)। মানে চাঁদের দূরত্বে পৃথিবীর ছায়ার ব্যাস চাঁদের ব্যাসের ২.৭ গুণ। এবার সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর কতগুণ তা সহজ অঙ্ক কষেই বের করা যায়। আপনারা সে অঙ্ক কষার চেষ্টা করতে পারেন (না পারলে বর্ত্তমান লেখকের 'প্রাথমিক জ্য়োতির্বিজ্ঞান' গ্রন্থ দেখতে পারেন)। অঙ্ক কষে দেখুন যে, সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ১১০ গুণ। আয়তন ব্যাসের ঘনের সমানুপাতিক বলে সূর্যের আয়তন পৃথিবীর আয়তনের ১১০-এর ঘন বা প্রায় ১৩,০০,০০০ গুণ হবে। অর্থাৎ, সূর্যের পেটে প্রায় তের লক্ষ পৃথিবী এঁটে যাবে!
চাঁদ ও পৃথিবীর ব্যাসের অনুপাত কত? আমরা চাঁদের ব্যাস ১ ধরলে সূর্যের ব্যাস=৪০০। সুতরাং পৃথিবীর ব্যাস=সূর্যের ব্যাসের ১১০ ভাগের এক ভাগ=৪০০/১১০=৩.৬ (প্রায়)। তাহলে পৃথিবীর ব্যাস ও চাঁদের ব্যাসের অনুপাত=৩.৬ঃ১, মানে চাঁদের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের চারভাগের একভাগ প্রায় (তার চেয়ে কিছু বেশী)। অবশ্য বিজ্ঞানীরা আরো ভাল ক'রে হিসাব ক'রে দেখেছেন ৩.৬-এর চেয়ে ৩.৭ সংখ্যাটাই আরও সঠিক। তাহলে পৃথিবীর আয়তন চাঁদের (৩.৭)-এর ঘন বা ৫০ গুণ (প্রায়)।
অ্যারিস্টার্কাসের হিসাবে অবশ্য চাঁদের দূরত্বে পৃথিবীর ছায়ার ব্যাস চাঁদের দ্বিগুণ। আর তিনি তাঁর হিসাবে সূর্যের দূরত্ব চাঁদের দূরত্বের ১৯ গুণ পেয়েছিলেন। সেই মতো তিনি বলেছিলেন সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ৬.৭ গুণ এবং আয়তন পৃথিবীর আয়তনের ৬.৭-এর ঘন বা ৩০০ গুণ (প্রায়)। পরিমাপে ভুল হলেও তাঁর পদ্ধতিটা সঠিক, এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। তাঁর পদ্ধতি অবলম্বন ক'রে আজকের দিনে আমরা সঠিক পরিমাপ পেতে পারি।
সূর্য যখন পৃথিবীর চেয়ে অত বড় তখন পৃথিবীর চারদিকে সূর্য না ঘুরে সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘোরাটাই তাঁর স্বাভাবিক বলে মনে হল। বুধ আর শুক্র যে সূর্যের চারদিকে ঘোরে সেকথা আগেই বলে গিয়েছিলেন পন্টুসের হেরাক্লিদেস (৩৮৮-৩১৫ খ্রীঃপূঃ)। হেরাক্লিদেস আরো বলেছিলেন তারায় ভরা আকাশ নয়, পৃথিবীটাই পশ্চিম থেকে পূর্বে রোজ এক পাক ক'রে আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবী থেকে ধ্রুবতারা পর্যন্ত রেখাটাকে অক্ষ ক'রে। এরই ফলে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারার প্রত্যহ পূর্ব থেকে পশ্চিমে গতি লক্ষ্য করা যায়। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর বার্ষিক গতির কথা অবশ্য হেরাক্লিদেসের মাথায় আসেনি। সেটা এল অ্যারিস্টার্কাসের মাথায়। তিনি বিশ্বজগতের কেন্দ্র থেকে পৃথিবীকে হটিয়ে সেখানে সূর্যকে বসালেন। বললেন বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি সবাই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। আর আকাশের তারারা আছে সেখান থেকে বহু গুণ দূরে। সেইসঙ্গে হেরাক্লিডিস উদ্ভাবিত পৃথিবীর আহ্নিক গতির কথাও তিনি স্বীকার ক'রে নিলেন। এই আহ্নিক গতির জন্যই সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-তারার দৈনিক উদয়-অস্ত হয়। আর বার্ষিক গতির জন্য কী হয়? সেজন্য তারাদের পটভূমিতে সূর্যকে রোজ প্রায় ১° ক'রে পশ্চিম থেকে পূর্বে সরে যেতে দেখি। পৃথিবী তার কক্ষপথে পশ্চিম থেকে পূর্বে যত ঘুরবে, সূর্যকে তত পশ্চিম থেকে পূর্বে এক তারা ছেড়ে অন্য তারায় আসতে দেখা যাবে। এক বছর পরে সে আবার ফিরে আসবে আগের তারাটির পাশে। তারারা যে সূর্যের চেয়ে বেশী দূরে তা কিন্তু খালি চোখে আমরা বুঝতে পারি না। এর কারণ আমাদের দৃষ্টির গভীরতা অত দূরে কাজ করে না। পৃথিবী থেকে দেখে মনে হয় চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা সবাই সমান দূরে, তাই আকাশটা একটা ফাঁকা গোলকের মতো মনে হয়। আর মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনির রোজ পূর্বে উদয় ও পশ্চিমে অস্ত যাওয়া পশ্চিম থেকে পূর্বে পৃথিবীর অক্ষাবর্তনের ফল। তারা যে সূর্যের চারদিকেও ঘোরে তা বুঝবেন কী ক'রে? সেটা বোঝা যায় তারাও পশ্চিম থেকে পূর্বে একতারা ছেডে় অন্য তারায় আসে বলে। তারাদের পটভূমিতে পশ্চিম থেকে পূর্বে পুরো এক পাক খেতে মঙ্গলের ৬৮৭ দিন, বৃহস্পতির ১২ বছর, শনির ২৯½ বছর লাগে। এই গতি আসলে তাদের সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর চেয়েও দূরে থেকে আবর্তনের ফল। তবে মাঝে মধ্যে গ্রহগুলি পশ্চিম থেকে পূর্বের তারায় না এসে পূর্ব থেকে পশ্চিমের তারার দিকে যায়, একে বলে বক্রগতি। এটা কেন হয়? মঙ্গলের কথা ভাবুন। সূর্যের চারদিকে নিজ নিজ কক্ষে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবী আর মঙ্গল একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর পাশাপাশি এসে পড়ে। তখন অপেক্ষাকৃত দ্রুতগামী পৃথিবী মঙ্গলকে অতিক্রম ক'রে চলে যায়। ফলে পৃথিবী থেকে দেখলে মনে হয় মঙ্গল যেন উল্টা দিকে যাচ্ছে। গ্রহদের বক্রগতির এই ব্যাখ্যা অ্যারিস্টার্কাস কতটা করতে পেরেছিলেন তা আমার জানা নেই। কোপার্নিকাস এই ব্যাখ্যাটা করেছিলেন। গ্রহগুলি পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে ভাবলে কেন তারা পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘুরতে ঘুরতে কখনো কখনো পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাবে এই খামখেয়ালিপনা ব্যাখ্যা করা দুষ্কর।
পৃথিবী যদি সূর্যের চারদিকে ঘোরে তবে সারা বছর জুড়ে নক্ষত্রমণ্ডলগুলির আকৃতিতে একটা পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা উচিত। কালপুরুষের কথা ভাবুন। পৃথিবীর কক্ষপথের বিভিন্ন অবস্থান থেকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে দেখার জন্য সারা বছর তাকে একই রকম দেখার কথা নয়। পৃথিবীর আহ্নিকগতির জন্য যেমন তারাদের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ঘুরতে দেখা যায় তেমনি বার্ষিক গতির জন্যও তো তারাদের একটা গতি লক্ষ্য করা উচিত? পৃথিবীর কক্ষপথের একটা বিন্দু থেকে কালপুরুষকে আজকে যেমন দেখি, এক বছর পর পৃথিবী সেই বিন্দুতে ফিরে এলে তাকে আবার আগের মতোই দেখব কিন্তু ৬ মাস আগে-পরে দেখলেও কালপুরুষকে একই রকম দেখায় কেন? এর উত্তরে অ্যারিস্টার্কাস বললেন যে সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাসের তুলনায় তারাদের দূরত্ব বহুগুণ বেশী। তাই পৃথিবীর বার্ষিকগতির জন্য তারাদের কোনো বার্ষিক লম্বন (পৃথিবীর বার্ষিক গতির জন্য তারাদের ঐগতিটাকে 'বার্ষিক লম্বন' বলে) দেখা যায় না। কক্ষপথে পরিক্রমণরত পৃথিবীকে নিয়ে সূর্য তারাদের দূরতে তুলনায় একটি বিন্দু বিশেষ। এইভাবে তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রসার বহুগুণ বাড়িয়ে দিলেন।
অ্যারিস্টার্কাসের চেয়ে প্রায় ২৩ বছরের ছোটো সমসাময়িক কালের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী আর্কিমিডিস তাঁর বিখ্যাত 'Sand Reckoner' গ্রন্থে অ্যারিস্টার্কাসের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধারণার কথা বলে গেছেন। আর্কিমিডিস তাঁর ঐ বইয়ে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে বালুকণা দিয়ে ভর্তি করতে কতগুলি বালুকণা লাগবে সেই বিশাল সংখ্যাটি হিসাব করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গেই তিনি বলেছিলেন অ্যারিস্টার্কাসের ব্রহ্মাণ্ডের ধারণা। তবু, দুঃখের বিষয়, অার্কিমিডিস অ্যারিস্টার্কাসকে সমর্থন করেননি।
অ্যারিস্টার্কাস তাঁর সমসাময়িক কালের চেয়ে সহস্রাধিক বছর এগিয়ে ছিলেন। তাঁকে বোঝার মতো মানুষ তখন ছিল না। পশ্চিম এশিয়া মাইনরের সমুদ্র উপকূলের কাছে তখনকার দিনের বিখ্যাত নগরী মিলেটাসের সামোস দ্বীপে খ্রীষ্টপূর্ব ৩১০ সালে তাঁর জন্ম। জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র তখন মিলেটাস বা সামোস নয়, গ্রীসের মূল ভূখণ্ডের এথেন্সও নয়, তা তখন চলে গেছে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত গ্রন্থাগারে। সামোস দ্বীপেই জন্ম হয়েছিল বিখ্যাত পণ্ডিত পিথাগোরাসের, তাঁর প্রায় তিন শতাব্দী আগে। অ্যারিস্টার্কাসের প্রায় দুই শতাব্দী আগে মিলেটাসের উত্তরে ক্লাজোমেনায়ে জন্মেছিলেন অ্যানােক্সাগোরাস নামে আর এক পণ্ডিত। পেরিক্লিসের আমলে তিনি এথেন্সে এসেছিলেন। চাঁদের যে নিজস্ব আলো নেই, চাঁদ যে সূর্যালোকে আলোকিত হয় একথা তিনি বলেছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন চন্দ্রকলার কারণ ব্যাখ্যা করার। তিনি আরো বলেছিলেন চাঁদ মৃত্তিকা দিয়ে তৈরী এবং সূর্য একটা বড়, উত্তপ্ত, অগ্নিময় প্রস্তর। বলেছিলেন সূর্য নাকি অনেক বড়, এমনকি সমগ্র পেলপনেসাসের চেয়েও বড়! তখনকার লোকেরা অ্যানােক্সাগোরাসের এইসব কথা মেনে নিতে পারেননি। তখন লোকে ভাবত সূর্য ও চন্দ্র দুই দেবতা বিশেষ। অ্যানােক্সোগোরাস পেরিক্লিসের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক ব্যক্তিত্বে পেরিক্লিস আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু পেরিক্লিসের শত্রুরা অ্যানােক্সাগোরাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। ধর্মবিরুদ্ধ মতবাদ ও নাস্তিকতার অভিযোগে তাঁর কারাদণ্ড হয়েছিল। সম্ভবত পেরিক্লিস কোনোরকমে তাঁকে কারামুক্ত করতে পেরেছিলেন। অ্যানােক্সাগোরাস এথেন্স ত্যাগ ক'রে চলে যান। পরবর্তী কালে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন চাঁদ কেন বাড়েকমে, গ্রহণ কেন হয় তা নিয়ে ভাবার কিছু নেই, ওটা চাঁদের স্বভাব। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের চিন্তায় ছিল প্রধানত নীতিবাদ ও ধর্মের প্রাধান্য। অ্যারিস্টার্কাস জন্মেছিলেন অ্যারিস্টটলের প্রায় ৯৮ বছর পরে। তবু তাঁর সমসাময়িক আলেকজান্দ্রিয়ার বড় বড় পণ্ডিতেরা তাঁর যুগান্তকারী তত্ত্বটিকে সমর্থন করেননি। সেদিনকার চিন্তাবিদেরা তখনো অতটা সাহস অর্জন করতে পারেননি। ক্লিন্থেস নামে সমসাময়িক এক পণ্ডিত বলেছিলেন,“গ্রীকদের কর্তব্য সামোসের অ্যারিস্টার্কাসকে অধর্মের জন্য অভিযুক্ত করা। পর্যবেক্ষণলব্ধ কিছু ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে তিনি কিনা এই মহাবিশ্বের বাসগৃহ পৃথিবীকে বৃত্তপথে চলমান এবং ঘূর্ণায়মান ভেবেছেন !” প্রাচীনকালে শুধু একজন মাত্র পণ্ডিত অ্যারিস্টার্কাসকে সমর্থন করেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি হলেন টাইগ্রিস নদী তীরের সেলেকিউস (জীবনকাল ১৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি)।
সৌরজগৎ নিয়ে অ্যারিস্টার্কাসের বইটি কিন্তু পাওয়া যায়নি। তাঁর শুধু একটি বইই পাওয়া গেছে, সেটির নাম 'সূর্য ও চাঁদের আকার ও দূরত্ব প্রসঙ্গে' (On The Size and Distances of the Sun and the Moon)। এই বইয়ে আছে শুধু চাঁদ ও সূর্যের দূরত্বের অনুপাত এবং সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদের ব্যাসের অনুপাতের আলোচনা। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর বার্ষিকগতির কথা এ বইয়ে নেই। এর কারণ কী? সৌরজগতের তত্ত্ব তিনি যে সত্যি সত্যিই আবিষ্কার করেছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর্কিমিডিস Sand Reckoner নামক বিখ্যাত গ্রন্থে অ্যারিস্টার্কাসের সৌরকন্দ্রিক তত্ত্বের কথা পরিষ্কার বলে গেছেন, এবং এই বিষয়ে আর্কিমিডিসের মতো বিদ্বাণের সাক্ষ্যকে চূড়ান্ত ধরার অসুবিধা নাই।
অ্যারিস্টার্কাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গেলেও বেঁচে আছে তাঁর বিরুদ্ধে বহু পণ্ডিতের সমালোচনা। 'সূর্য ও চাঁদের আকার ও দূরতম প্রসঙ্গে' বইটিতে তিনি কেন ভূকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী মেনে নিয়েছিলেন? অ্যানােক্সাগোরাসের দুর্দশার কথা আমরা জানি। অ্যারিস্টার্কাসের প্রায় ১৯০০ বছর পরে গ্যালিলিওর লা²নার কথাও আমরা জানি। হতে পারে এই ধরণের একটা ভীতি অ্যারিস্টার্কাসকে প্রভাবিত করেছিল। সূর্য ও চাঁদের আকার নির্ণয়ে যে পদ্ধতি তিনি আবিষ্কার করেছিলেন তাতে ভূকেন্দ্রিক ও সৌরকেন্দ্রিক উভয় তত্ত্বেই কাজ চলে। তাই লোকে মেনে নেবে না ভেবে চট ক'রে সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের কথা না বলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেছিলেন। আবার এমনও হতে পারে যে সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের আবিষ্কার তাঁর 'সূর্য ও চাঁদের দূরত্ব ও আকার বিষয়ে' বইটি লেখার পরবর্তী কালের চিন্তা এবং গবেষণার ফল।
কোপার্নিকাস তাঁর সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন ১৫৪৩ সালে। অ্যারিস্টার্কাসের সঙ্গে তাঁর প্রায় ১৮০০ বছরের ব্যবধান। ভাবতে অবাক লাগে অ্যারিস্টার্কাস এত আগে বলে গেলেও গ্রহদের গতিরহস্য পরবর্তী ১৮০০ বছর ধ'রে মানুষ বুঝতে পারেনি! গ্যালিলিও বলেছিলেন যে কোপার্নিকাস সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের আবিষ্কর্তা নন, তিনি প্রাচীনকালের এই বিস্মৃতপ্রায় তত্ত্বটিকে উদ্ধার করেছিলেন। কোপার্নিকাস যখন ইটালীতে ডাক্তারী পড়তে গিয়েছিলেন তখন সদ্য আবিষ্কৃত প্রাচীন গ্রীক পণ্ডিতদের লেখাগুলি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কোপার্নিকাস কিন্তু অ্যারিস্টার্কাসের থেকে নকল করেননি। একটি চিঠিতে কোপার্নিকাস লিখেছেন,“সিসেরোর মতে সাইরাকিউজবাসী হিসেটাস পৃথিবীর গতির কথা বলেছিলেন। প্লুটার্কের মতে প্রাচীনকালে আরো কেউ কেউ এই মতে বিশ্বাসী ছিলেন।” এখানে প্লুটার্ক অ্যারিস্টার্কাসের কথা লিখেছিলেন। কাজেই কোপার্নিকাস অ্যারিস্টার্কাসের তত্ত্বের কথা জানতেন। তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ 'স্বর্গীয় গোলকদের ঘূর্ণন'-এর পাণ্ডুলিপিতে কোপার্নিকাস অ্যারিস্টার্কাসের কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু বইটি ছাপাবার সময় তা বাদ পডে় যায়। অ্যারিস্টার্কাসের প্রায় বিস্মৃত তত্ত্বটির কতটুকু যে কোপার্নিকাসের হাতে পৌঁছেছিল সেটা অবশ্য খুবই সন্দেহজনক। প্রাচীনকালে কারও কারও রচনায় সেৌরকন্দ্রিক তত্ত্বের সমর্থন আছে সেটুকু জেনেই তিনি খুশি ছিলেন। তারপর বহুবছর ধ'রে নানা গাণিতিক হিসাবনিকাশ ক'রে ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বের চেয়ে সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের শ্রেষ্ঠত্ব তিনি প্রমাণ করেছিলেন। কোপার্নিকাস পেয়েছিলেন গ্যালিলিও এবং কেপলারের মতো যোগ্য উত্তরসূরী। সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে কোপার্নিকাস, কেপলার ও গ্যালিলিওর। তবু অ্যারিস্টার্কাসকে আমরা ভুলে যেতে পারি না। তাঁর বুদ্ধি এবং সাহস আমাকে অবাক করে।