 |
কাজী শফিকুর রহমান |
সোনালি অতীতের অনেক কথাই মনে পড়ে। মন চায় সেই অতীতে ফিরে যাই।চাই আগের মতো সবার সাথে জম্পেশ আড্ডা মারতে। কিন্তু তা তো হবার নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে তেমনি একটি ঘটনা ----
দিনক্ষণ মনে নেই। সম্ভবত ১৯৮৮ সাল হবে তখন। এক বন্ধুর হলে গেলাম। অনেক কথাবার্তা হলো। উঠে আসবো তখনি বলল
-যাবি তাহলে! এককাপ চা অন্তত খেয়ে যা।
- ধন্যবাদ বন্ধু ,আরেকদিন এসে খেয়ে যাবো। আজ তাড়া আছে।
- ঠিক আছে, যা তাহলে।
এরপর কয়েকদিন কেটে গেলে।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হলে থাকতাম। সেই হলে অর্থনীতি বিভাগের ব্যাচমেট রোজের কাছে একদিন অন্য হলের একজন বন্ধু এলো। সেসময়ে আমিও ছিলাম। বন্ধুটির যাবার সময় রোজ বললো - দোস্ত যাবি তাহলে! এককাপ চা অন্তত খেয়ে যা।বন্ধুটি ধন্যবাদ দিয়ে চা পান না করে চলে গেল।
রুমে এসে ভাবলাম - অনেকক্ষণ তো ছিল সে বন্ধুটি। তবে শুরুতে আমন্ত্রণ না করে কেন যাবার সময় করলো? ওরে বাবা! এবার বুঝলাম। এরপর যদি কোনদিন কেহ আমাকে বলে তবেই বুঝবে।
প্রচণ্ড রোদফাঁটা এক দুপুরে তৃষ্ণা আর খুদার জ্বালায় অস্তির হয়ে হলে ফিরছি। তার আগে বাস স্ট্যান্ডে আমাদের শহুরে ললনাদের দেখতে ভুল করি নাই। অডিটোরিয়ামের পাশ দিয়ে একাই ফিরছি। একটু চিপায় রোজের মতো একজনকে মনে হলো। একটু একটু করে পা ফেলছি আর রোজ আমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছে। আরেকটু কাছে আসতেই কড়া ইন্ডিয়ান পারফিউমের গণ্ড নাকে আসলো। পায়ে হেভি কেডস, সিঙ্গাপুরের জিনস, থাইল্যান্ডের গেঞ্জি আর গলায় সোনার চেন পরে মাঞ্জা মারছেন আমাদের হবু অর্থনীতিবিদ রোজ সাহেব। মনে হচ্ছে হট নায়ক অনিল কাপুর।আমি কাছে আসতেই ব্রিটিশ ’৫৫৫’ প্যাকেট বের করে চুলগুলোতে একটা ঝাঁকি মেরে রজনী কান্তের মতো একটা সিগারেট উপরে ছুঁড়ে মেরে সেটি মাটিতে পড়ার আগে ক্ষিপ্র গতিতে দুই ঠোঠের মধ্যে নিয়ে স্টাইল মেরে সিগারেটটি ধরাল। সিগারেটটি ধরার পর প্যাকেটটি একটু দূরে ছুড়ে মারল। আরে এ তো সেই রোজ! যে কিনা হলে আলু ভর্তা কিংবা কোন কোন দিন এক আধতা ডিম ভেজে কোনমতে খাবার খায়। খাওয়ার পর নাসির বিড়ি ফুঁকিয়ে অর্থনীতিবিদগিরী দেখায় আর বাহিরে এত উদার হস্ত। আর দু পা এগোতেই এক অতীব সুন্দরি এক ললনার মুখ দেখা গেল।
ওদের দেখে ভাবছি কথা বলব কি না। ভাবনা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাবার আগে রোজ বলে উঠল – কি রে হলে যাচ্ছিস?
মনে মনে বললাম –হলে না গিয়ে এই ভর দুপুরে কোন ললনার সাথে ধুতরা ফুলের সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলব নাকি! কিন্তু তা না বলে বললাম – হাঁ রে যাচ্ছি তো হলে। তুই কখন ফিরবি?
- ওকে হলে দিয়ে একটু পরে ফিরব।
- কে উনি? উনার সাথে কার যেন একটু মিল খুঁজে পাচ্ছি।
বলার সাথে সাথে রোজের চোখেমুখে আত্মতৃপ্তির ভাব লক্ষ্য করলাম। সে বলে উঠল -কার সাথে মিল রে? জানো, ও না খুব সহজ সরল। নিশ্চয় রংপুরে মফিজের নাম শুনেছো। ওকে দেখলে তোমাকে আর মফিজ দেখতে হবে না।
শালা আমাকে মফিজ বলে। আজ বুঝবি মফিজ কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি।
কিন্তু বিরক্তির ভাব চোখেমুখে ফুটে না তুলে বরং একটু চিন্তিত ভাব নিয়ে বললাম – মোহিনীর সাথে।
- মোহিনী! মানে?
- কি রে খালি তো সারাক্ষণ আড্ডা মারিস, আর যখন মোহিনীর নাম শুনিস তখন তো প্রায় লাফিয়ে উঠিস?
সঙ্গের সাথী সেই ললনা রাগত কণ্ঠে বলে উঠল – কে ভাই মোহিনী? আর ওর সাথে কি সম্পর্ক?
ললনার প্রশ্ন শুনে বুঝলাম , আজ আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন। বললাম – আরে এ মোহিনী সেই মোহিনী নয়। আপনি যা ভাবছেন তা নয়।তেজাব ছবিতে মাধুরী দীক্ষিত 'মোহিনী' চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কি রে রোজ তুই সহ আমরা অনেকে তো 'তেজাব' দেখেছি । মোহিনী চরিত্রের কথা ভুলে গেছিস! নিশ্চয় এর সাথে সাথে এক দো তিন নাচের কথাও মনে নেই?
আমার বলার সাথে সাথে রোজের ভয়ার্ত ভাব কেটে গিয়ে একটা প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল। আর মোহিনী ম্যাডামের মুখে লজ্জা রাঙানো পূর্ণিমা চাঁদ দেখা গেল। মোহিনী বলে উঠল – কি যে বলেন ভাই! কোথায় মাধুরী দীক্ষিত আর কোথায় আমি! তাঁর সাথে কি আমার তুলনা চলে।
- আলবত চলে। ওরা আমাদের মতো অভাব অনটন আর দুঃখ কষ্টে থাকলে বুঝত। এক গ্লাস পানি পর্যন্ত ঢেলে পান করতে হয় না।
- ঠিক বলেছেন ভাই। বলেই একগাদা অভাব অভিযোগের কথা বলতে লাগল। মোহিনী বলছে আর আমি আড় চোখে রোজের দিকে তাকাচ্ছি। আর ভাবছি- তুই শেষ রে রোজ! রোজের চোখমুখে বিরক্তের ভাব ফুটে উঠছে। আর আড় চোখে ছুঁড়ে মারা প্যাকেটটির দিকে বারবার তাঁকাচ্ছে।প্রেমিকাকে বাদ দিয়ে বারবার প্যাকেটটির দিকে তাকাচ্ছে কেন চান্দু ? নিশ্চয় কিছু আছে বাপধন। প্যাকেটের দিকে এগাতেই রোজ বলে উঠল
– আরে কী করিস?
- নারে হঠাৎ ছোট একটু লেখার দরকার পড়ল। প্যাকেটটি ছিঁড়লে লেখার কাজ হবে।
- বাদ দে তো। ফেলে দেওয়া নোংরা প্যাকেট দিয়ে কি হবে। তারচেয়ে এই নে তোর লেখার কাগজ। বলেই একটু উঠে দাঁড়িয়ে পাছার নীচে এতক্ষণ বসে থাকা প্যাডের সাদা কাগজটি আমার দিকে দিল। শালা! তোর বসে থাকা পাছার কাগজটি নোংরা হলো না হলো ওই প্যাকেটটি। নিশ্চয় ওখানে সিগারেট আছে । আমাকে নিতেই হবে। কিছু হিবিজিবি লিখে ইচ্ছাকৃত ভাবে কলমটি ফেলে দিলাম। একটু বকবক করে খুদার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে বললাম - যাই রে।
- যাবি তাহলে! এককাপ চা অন্তত খেয়ে যা।
সদ্য দেখা জুদাই ছবির কথা মনে পড়ল। সেই ছবিতে জনি লিভার এক সুন্দরি মেয়ের মুখে – আব্বা জুব্বা ডাব্বা শুনে গদগদ হয়েছিল। কিন্তু জনি লিভার জানতো না সেই মেয়েটি 'আব্বা জুব্বা ডাব্বা ' ছাড়া আর কোন কথা বলতে পারতো না। যখন সে বুঝলো তখন মাথার চুল ছিড়া ব্যতীত কিছুই করার ছিল না। আজ তোকে সেই জনি লিভার বানিয়েই ছাড়বো। আমাকে রংপুরের মফিজ বলার স্বাদ চিরতরে বন্ধ করবো।
- খাওয়াবি চা? তাহলে খাওয়া।
রোজ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল – বাদ দে, দুপুরবেলা চা না খাওয়াই ভাল। তারচেয়ে হলে গিয়ে ভাত খা। চা এর পাওনা বিকালে মিটাবো।
শালা তুই বিকালে খাওয়াবি! তাহলে তো দুনিয়া উল্টে যাবে। মুখে এসব না বলে বললাম – ঠিক বলেছিস বন্ধু। এখন ভাত খাবার সময়। চল ভাত খাই। মোহিনী ম্যাডামের তো খুদা লেগেছে তাই না?
- না না ভাই। এই ,তুমি না ওনাকে খাওয়াতে চাইলে তাহলে ভাইকে নিয়ে খেয়ে এসো। আমি হলে ফিরলাম।
ললনা কথা শুনে বিষম খাবার যোগাড় হলো। মনে মনে আওড়াচ্ছি - আরে মোহনী, তুমি গেলে তো আমার আর ওর কাছ থেকে খোসানো হবে না। কোনভাবে সেই অপ্সরীকে যেতে দেওয়া যাবে না। আমি বললাম – এ কি কথা বললেন! আপনি যাবেন আর আমি খাব।কখনই নয়। খেলে একসাথে খাবো।
- কোথায় খেতে চান?
-দুপুর হয়ে গেছে।কাছাকাছি কোথাও যাওয়া যায়। সবচেয়ে ভাল হয় সেন্ট্রাল ক্যাফেটেরিয়ায়।
সেদিন ছিল সম্ভবত সোমবার। আর সোমবারে ক্যাফেটেরিয়াতে স্পেশাল বিরিয়ানি হয়।
বন্ধুটির চোখেমুখে ঘোর আমবশ্যা নেমে এসেছে। সেই ললনা খুব সুরেলা কণ্ঠে বলে উঠল – এই চলো না।
ক্যাফেটেরিয়ার উদ্দেশ্যে দু এক কদম পা বাড়ালাম। রোজের মেঘাচ্ছন্ন মুখটি কণে বিদায় দিবার সময় বাবা মা এর হয় যেমনটি হয় প্রায় তেমনটি হলো। অনিল কাপুর শেষবারের মতো প্যাকেটটির দিকে তাঁকাল। আরো দু কদম এগতে আমি বুক পকেটে হাত দিয়ে বললাম – এই ছেড়েছে! আমার কলমটি মনে হয় লিখতে গিয়ে ভুল করে ফেলে এসেছি। তোমরা আগাও আমি আসছি।
বলেই দ্রুত সেখানে গিয়ে কলম আর প্যাকেটটি তুললাম। প্যাকাটিতে হাত দিয়ে বুঝলাম অন্তত চার পাঁচটা সিগারেট সেখানে আছে। দ্রুত সেটি প্যান্টের পকেটে চালান করে দিয়ে ওদের সাথে এক হলাম। রাস্তায় মোহিনীর আর একদফা প্রশংসার সাগরে ভাসালাম। মোহিনী খুব খুশিতে গদগদ হয়ে আসে।
ক্যাফেটেরিয়ায় এসে মোহিনী বলে উঠল – কী খাবেন ভাই?
গরম বিরিয়ানির খুশবু পুরো ক্যাফেটেরিয়াময়। বললাম – বিরিয়ানি।
রোজ রূপী অনিল কাপুর সাথেসাথে বলে উঠল – আরে বিরিয়ানি খেলে পেট খারাপ হতে পারে, তারচেয়ে নাস্তা খাই।
- ছি ছি ! তুমি এত কিপটে। মানুষ কি আর এমনি বলে - অর্থনীতিতে যারা পড়ে তার হাড় কিপটে হয়। ছি ছি তোমার এই কিপটেমির কারণে ভাইটি কী মনে করবেন।
মোহিনীর রাগ দেখে রোজ নাকি সুরে তিন প্লেট বিরিয়ানির অর্ডার করল। যথাসময়ে বিরিয়ানি চলে এলো। এবার আমি খুব আয়েসের ভঙ্গিতে বিরিয়ানি চিবচ্ছি আর তাদের দুজনার প্রশংসা করে চলছি। আর রোজের কালিমাখা মুখ দেখে মনে মনে বললাম – আজ বেচারা কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছে। তা না হলে কি এই বাঁদরের সাথে দেখা হয়!
খাওয়া শেষে রোজকে বললাম – দোস্ত অনেকদিন পর আজ না যোশ করে খেলাম। সিগারেট চা খাওয়াবি না।
রাগ করে বলল- না। এত বেশি চা চা করিস না তো। যা ভাগ।
মোহিনীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে সেই প্যাকেটটি খুলে একটা সিগারেট বের করে ভাবলাম – রোজ কি আমাকে দেখে আর কখনো বলবে না -দোস্ত যাবি তাহলে! এককাপ চা অন্তত খেয়ে যা।
লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। সেই সংগে রহিল ঈদ মোবারক। সাথে রহিল চায়ের আমন্ত্রণ। কী ভাবছেন, আপনারা উঠার সময় বলবো - যাবেন, এক কাপ চা পান করে অন্তত যান। আরে না, আপনারা বসার সাথে সাথে এক কাপ ধূমায়িত চা পাবেন। ভাল থাকুন। বাঁচতে হলে প্রাণ খুলে হাসুন।
পুনশ্চঃ
লেখা এবং ছবি লেখকের fb ID থেকে সংগৃহীত।